গাছে গাছে সৌরভ ছড়াচ্ছে আমের মুকুল

প্রকাশ | ১৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গল, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, বগুড়ার দুপচাঁচিয়া ও চট্টগ্রামের রাউজানে সোনালি হলুদ রঙের মুকুলে ভরে যাওয়া আম গাছ -যাযাদি
মুকুলে মুকুলে ছেঁয়ে গেছে বিভিন্ন স্থানের আমগাছ। সেই মুকুলের ম-ম গন্ধে মুখরিত চারদিক। রাস্তাঘাট, ছাদ, বাগান সবখানে আমের মুকুল যেন সৌরভ ছড়াচ্ছে। মুকুল দেখে এবার আমের বাম্পার ফলনের আশা চাষিদের। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট- শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলে আম গাছগুলোতে মুকুলে ভরে গেছে। বসন্তের নানা ফুলের সঙ্গে সৌরভ ছড়াচ্ছে গাছে গাছে আমের মুকুল। আর এ মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে প্রকৃতি। মনকে করে তুলছে আরও প্রাণবন্ত। এ বছর আবহাওয়া আমের জন্য অনুকূলে রয়েছে। সোনালি হলুদ রঙের আমের মুকুলের মনকাড়া ঘ্রাণ। গাছে গাছে মৌমাছির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে গুন গুন শব্দে। ছোট পাখিরাও মুকুলে বসছে মনের আনন্দে। এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে শ্রীমঙ্গল পৌর এলাকার একটি আম গাছে। দৃশ্যটি যে কাউকেই কাছে টানবে। দুরন্ত শৈশবে কাঁচা-পাকা আম পাড়ার আনন্দ অনেকেরই স্মৃতিতে চির অমর। তাছাড়া বর্তমানে আম বাংলাদেশের প্রধান চাষযোগ্য অর্থকরী ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং স্বাদ-গন্ধে আম একটি অতুলনীয় ফল। বিশেষ করে শীতের শেষে যখন আমের মুকুল আসে, আর সেই মুকুল থেকে যখন ছোট ছোট আম বের হয়, সেই আম পাড়তে গিয়ে মায়ের বকুুনি বৃদ্ধ বয়সে অনেকের কাছে স্মৃতিপটের চেনা ইতিকথা। উপজেলার অনেক স্থানে এবার আমের মুকুল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কলেজ রোডের লন্ডনীবাড়িতে আমের মুকুল এসেছে কয়েকটি গাছে। এছাড়াও উপজেলার সদর ইউনিয়নসহ প্রায় ৯টি ইউনিয়নের গ্রামগঞ্জের এলাকার অনেক বাড়ির আঙিনায়, পুকুর ধারে আম গাছে মুকুল ধরেছে। এর মধ্যে চা বাগান কালীঘাট, রাজঘাট, ভাড়াউড়া, সাতগাঁও, জাগছড়া, সোনাছড়া, বর্মা ছড়া, বিদ্যাবিল, উদনাছড়া, ভুরভুরিয়াছড়া, মাজদিহি, কাকিয়াছড়া, হরিণছড়াসহ গ্রামগঞ্জ ও শহরের প্রায় সব এলাকাতেই রয়েছে আমগাছ। তবে বেশি মুকুল এসেছে চা বাগানগুলোতে। কারণ বাগানগুলোতে আম গাছে পরিচর্যা হয় বেশি। আম চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই আম গাছের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। তবে গড়ে ওঠা নতুন আম জাতেরই গাছ বেশি হচ্ছে। গত বছরের চেয়ে টানা শীত ও কুয়াশার তীব্রতা এ বছর অনেক কম। তবে শীতে কিছু বৃষ্টি ও ঝড় তুফান হয়েছে। গতবারের মতো মৌসুমের শুরুতে শিলাবৃষ্টি হয়নি। তবে মাঝে-মধ্যেই আকাশে মেঘ জমে উঠছে। এ সময় শিলাবৃষ্টি হলে আমের মুকুলের ক্ষতি হবে। এর ওপর সামনে কালবৈশাখি ঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। তাই আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কাও কাজ করছে। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এবার আমের বাম্পার ফলন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, এ বছর শহর থেকে চায়ের বাগানগুলোতে গাছে মুকুলের পরিমাণ বেশি এসেছে। আমচাষি এবং সংশ্লিষ্ট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবার আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবং সময়মতো পরিচর্যা করলে চলতি মৌসুমে আমের ভালো ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর এ কারণেই আশায় বুক বেঁধে চা বাগানের আমচাষিরা শুরু করেছেন পরিচর্যা। তাদের আশা, চলতি মৌসুমে তারা আম থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। আমচাষি শ্যাম বিলাশ গোয়ালা জানান, বছরজুড়ে গাছের পরিচর্যা করার কারণে এখন প্রতি বছরই চা বাগানে আমের ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ হলো গাছে মুকুল আসার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে পুরো গাছে সাইপারম্যাক্সিন ও কীটনাশক দিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করে গাছ ধুয়ে দিতে হবে। এতে গাছে বাস করা হপার বা শোষকজাতীয় পোকাসহ অন্য পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যদি সঠিক সময়ে হপার বা শোষক পোকা দমন করা না যায় তাহলে আমের ফলন কমে যেতে পারে। এ বছর ৪০৯ হেক্টর আমের মুকুল এসেছিল। কিন্তু শীতকালে বৃষ্টি হওয়ায় মুকুল ঝড়ে পড়ে। তবে প্রায় ২৬৫ হেক্টর আমের ভালো মুকুল এসেছে। কালবৈশাখি ঝড় না এলে শ্রীমঙ্গলে আম ভালোই হবে বলে জানান তিনি। আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের আশপাশের এলাকায় রাজশাহীর মতো বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় না আম। তারপরও প্রতিটি বাড়িতে বা রাস্তার আশপাশে বেশ কিছু আমগাছ দেখতে পাওয়া যায়। এ বছর প্রায় প্রতিটি আম গাছে দেখা যাচ্ছে অজস্র মুকুল। এ মুকুল টিকে থাকলে এ বছর আমের ফলন হবে বাম্পার। এ রকমটিই আশা করছেন এলাকাবাসী। সম্প্রতি বিন্ন্নি ঘটনার প্রেক্ষিতে বেশ কয়েটি স্পটে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বেশ কিছু এলাকায় প্রতিটি আমগাছে এ রকম প্রচুর পরিমাণে মুকুল লক্ষ্য করা গেছে। উপজেরার ফতেপুর ইউনিয়নের লতবদী, দাবুরপুরা, দক্ষিণপাড়া, হাইজাদী ইউনিয়নের সিংহদী, ইলমদী, রাইনাদী এ সমস্ত এলাকায় প্রতিটি আমগাছে প্রচুর পরিমাণে মুকুল গাছের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে দেখা গেছে। এ যেন সবুজ পাতার সঙ্গে হলুদ বর্ণের আম্র মুকুলের এক অপরূপ মিতালী। রাজশাহীর মতো ল্যাংড়া আম, রাজ ভোগ আম, কাটারিয়া আম- এ রকম নাম ও জাতের আম এ এলাকায় না থাকলেও অন্যান্য ভেরাইটজি রকম ও নামের আম এ এলাকায় হয়ে থাকে। আম গাছ গুলো সাধারণত বাড়ির আঙ্গিনায়, বাড়ির পাশের খালি জায়গায় এবং মাঝে মধ্যে একটু বেশি জায়গা নিয়ে রোপিত হয়ে থাকে। বড় বড় রাস্তার দুই পাশেও আমগাছে সুশোভিত মুকুল বাতাসে দোল খেতে দেখা গেছে। এ বছর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় শীতের সময় তেমন একটা ঘন কুয়াশা না পড়ার কারণে আমের মুকুল অক্ষত আছে। কৃষকরা জানান, ঘন কুয়াশায় আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ঝড়ে পড়ে যায়। এ বছর এলাকায় তেমন ঘন কুয়াশা পড়েনি। তাই প্রাথমিকভাবে আমের মুকুলগুলো তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ফারুক ভূঁইয়া ও ছাদেকুর রহমার রিজন জানান, মুকুল যাতে ঝড়ে না পড়ে এ জন্য যা করণীয় সে সম্পর্কে এলাকাবাসীকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমের মুকুল ও গুটি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পরিচর্যার বিষয়ে তাদের বুঝিয়ে বলা হচ্ছে। দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় আমের মুকুলের ম-ম গন্ধে মুখরিত চারদিক। তবে গতবারের মত এবারও অনেক গাছে পর্যাপ্ত মুকুল আসেনি। যদিও এ উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ হয় না। হাতে গোনা দুই-একজন ব্যক্তির আম বাগান রয়েছে। তারা গাছে মুকুল আসার পূর্ব থেকে পাকার উপযুক্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত পরিচর্যা করে থাকেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বাড়ির আঙিনা, পুকুর পাড়, পতিত জমি, ও রাস্তা-ঘাটে যেসব আম গাছ রয়েছে সেগুলোতে তেমন পরিচর্যা করতে দেখা যায় না। বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ না হলেও গত বছর এ উপজেলায় ভালো উৎপাদন হয়েছিল। তবে এবার অনেক গাছেই মুকুল ধরেনি। উপজেলার যে কয়েকজন বাণিজ্যিকভাবে আম বাগান তৈরি করে চাষ করছেন তারা গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। উপজেলার দেবরাশন গ্রামের ইসমাইল হোসেন ও বালুকাপাড়া গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, তারা বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন জাতের আম গাছের চারা কিনে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেছেন। গত বছর তাদের বাগানে ভালোই আম হয়েছিল। এবারও যে পরিমাণ মুকুল ধরেছে সঠিক পরিচর্যা করলে এবারও আমের উৎপাদন ভালো হবে বলে আশা করছেন তারা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাজেদুল আলম বলেন, এ উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে তেমন আম চাষ না হলেও দিন দিন আমচাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাছের মুকুল যাতে ঝরে না পড়ে ও আমের উৎপাদন ভালো হয় সেজন্য তাদের কৃষি অফিস হতে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। রাউজান (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, রাউজানের পথেঘাটে, বাড়ির ছাদ বাগানে রোপণ করা প্রায় প্রতিটি আমের চারায় এখন ডালভাঙ্গা মুকুল। স্থানীয়রা জানান, গত সাত বছরে এই উপজেলায় আমের চারা রোপণ করা হয়েছে প্রায় চার লাখ। রাস্তাঘাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আঙিনা, পাকা বাড়ির ছাদ বাগানে এসব রোপণ করা হয়। লাগানো এসব চারা উন্নত জাত থেকে সৃষ্ট কলম (রূপান্তর করা চারা)। এবছর নব্বই শতাংশ চারা গাছে মুকুল শোভা পাচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের রাস্তাঘাট, মানুষের বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় থাকা ছোট বড় বাগানে দেখা গেছে ছোট ছোট আম গাছের ডালপালা মুকুলের ভারে নিচের দিকে নুয়ে পড়েছে। উপজেলার নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের আঙ্গিনা ও ছাদে দেখা গেছে গত দুই বছর আগে লাগানো আমের কলম গাছে মুকুলের ভারে ডাল ভেঙে পড়ার উপক্রম। পরিষদের চেয়ারম্যান সরোয়ার্দ্দি সিকদার মুকুল ভর্তি ছোট চারা গাছের ডাল রক্ষায় নিচে বাঁশের খুঁটি বেঁধে দিয়ে মুকুলের ওপর পানি ছিটাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ২০১৭ সাল থেকে রাউজানের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এ উপজেলায় ১২ লাখ চারা গাছ রোপণের জন্য প্রতিপ্রতিনিধি, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে দিয়েছেন। তার দেওয়া চারার মধ্যে ছিল ৫০ শতাংশ উন্নত জাতের আমের কলম। বাকি ৫০ শতাংশ ছিল নানা জাতের ফল ও ঔষধি গাছের চারা। ওই সময়ে রোপণ করা সব গাছে ঝুলছে মৌসুমি ফল। আম ছাড়াও বিভিন্ন মৌসুমী ফলের সারি সারি গাছ দেখা যায় সব রাস্তাঘাটে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাদ ও আঙিনায়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুম কবির বলেন, তিন বছরের নিচে যেসব আম চারায় বেশি মুকুল রয়েছে, সেসব চারায় একটি মুকুল রেখে সব মুকুল ভেঙে দিতে হবে। কারণ গাছকে ফলন দেওয়ার মতো পরিপক্ব করে তুলতে হবে। বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে না পড়লে রাউজানের উৎপাদিত আম এলাকার চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও সরবরাহ করা যাবে।