বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কর্মরত চা-শ্রমিক রুহিনীর সন্তানরা

দারিদ্র্যকে জয়

প্রকাশ | ১১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

মো. আব্দুল ওয়াদুদ, মৌলভীবাজার
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা-বাগানের একজন সাধারণ চা শ্রমিক ছিলেন শৈব্য বোনার্জি। চরম দারিদ্র্যতা ছিল যার নিত্যসঙ্গী। ডান পায়ে সমস্যা থাকায় স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনি চলতে পারতেন না। পরিবারের সদস্য বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি সেই পা দিয়ে কাপড় শেলাইয়ের বাড়তি আয়ে কোনো রকম সংসার চালতেন। পারিবারিক জীবনে দুই সংসার করেন তিনি। ফলে প্রথম সংসারে দুই ছেলে এবং দ্বিতীয় সংসারে তিন ছেলেসহ মোট পাঁচ ছেলে এবং এক মেয়ে সন্তানের জনক ছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী রুহিনী বোনার্জি বংশানুক্রমে একজন চা-শ্রমিক। তবে শিক্ষার প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। বাগানে শ্রমিকের কাজ করে ছেলেমেয়েদের বাগানে না রেখে পাঠাতেন স্কুলে। স্বপ্ন দেখতেন সফল মা হওয়ার। আর তাই তিনি করেছেন। রুহিনীর ছেলে বিপস্নব পরে এইচএসসি ও ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ২০০১ সালের এসএসএসি পরীক্ষায় সিলেট শিক্ষা বোর্ড হতে মানবিক শাখায় জিপিএ ৪.০০ পাওয়া শিমুল বোনার্জি এখন মৌলভীবাজার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির পদে কর্মরত রয়েছেন। তৎকালীন সেই ফলাফল ছিল সারা দেশের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য এবং বাংলাদেশের সমগ্র চা-বাগানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ জিপিএ। পরে শিমুল ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করে সিলেট এমসি কলেজে ইংরেজিতে সাহিত্যে পড়াশোনা করেন। একমাত্র মেয়ে সুপর্না বোনার্জিও এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করে সমাজবিজ্ঞানে বিএসএস (সম্মান) এমএসএস (সমাজবিজ্ঞান) সম্পন্ন করেন। পরে তিনি বিএড ডিগ্রি এবং সিলেট 'ল' কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। কনিষ্ঠ সন্তান শিপুল বোনার্জিও এমসি কলেজ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি (উদ্ভিদবিজ্ঞান) সম্পন্ন করেন। রুহিনীর ছেলে উজ্জ্বল এখন ঢাকার একটি ইন্ডাস্ট্রিজে চাকরি করেন। বিপস্নব চা বাগানের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তার স্ত্রী প্রতিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আরেক ছেলে সরল মায়ের চা-বাগানের কাজ নিয়ে রেজিস্ট্রার শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ও তার স্ত্রী সঙ্গীতা আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় জড়িত। শিমুল মৌলভীবাজার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির ও তার একমাত্র মেয়ে সুপর্না ও আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত। কনিষ্ঠ ছেলে শিপুল বোনার্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বরত আছেন। মৌলভীবাজার জেলায় মোট ৯২টি চা-বাগান রয়েছে। বাংলাদেশের চা-শমিকদের হেডকোয়ার্টার শ্রীমঙ্গলে। সারাদেশের শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া ও আন্দোলন পাকাপোক্ত করতে 'বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন' নামের সংগঠনের 'লেবার হাউস' প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৪ সালে। এই লেবার হাউস কার্যালয়ে একসময় মাত্র কয়েক টাকা বেতনে কাজ করতেন রুহিনীর স্বামী শৈব্য বোনার্জি। এখন তার সন্তানরা উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ভালো রোজগার করলেও তিনি দেখতে পারছেন না। চলে গেছেন পরপারে। চা জনগোষ্ঠী এখনো সুবিধাবঞ্চিত অসহায় দরিদ্র। বর্তমান সময় এই গোষ্ঠীর দারিদ্র্যতা কিছুটা কমেছে, বেড়েছে শিক্ষার হারও। এই পরিবারের সব সদস্য চা বাগানে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। জুডিসিয়াল আদালতের নাজির শিমুল বোনাজিী বলেন, খুব কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন আমার মা। এটা চা জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা হিসেবে মনে করি। এ রকম মা যেন সবাই পায়।' রুহিনী বোনার্জি বলেন, 'অভাব-অনটনের মধ্য দিয়েও আমার সন্তানদের মানুষ করে এখন আমি খুব খুশি। আমি চাই, আমার সন্তান সবসময় মানুষের উপকার করে যাক, কোনো ক্ষতি যেন না করে। তবেই আমার স্বার্থকতা।'