শীতল পাটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে দেলদুয়ারের পাটিশিল্পীরা

প্রকাশ | ১১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
বহুকাল ধরে ঐতিহ্যের সঙ্গে শীতল পাটি তৈরি করে আসছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাটি শিল্পীরা। এসব পাটি গুনে-মানে উন্নত ও আকর্ষণীয় ডিজাইনের হওয়ায় কালক্রমে দেশজুড়েই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। অথচ আধুনিক যুগে এসে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে শীতল পাটির কদরে অনেকটাই ভাটা পড়ে। ফলে বিপাকে পড়ে এ অঞ্চলের পাটি শিল্পীরা। তবে পাটি তৈরির কাজ যেন তাদের রক্তে মিশে আছে। তারা শত কষ্টের মধ্যেও বাব-দাদার এ পেশাকে বুকে লালন করে আসছে। সে কারণে সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে পাটি তৈরির মধ্য দিয়ে আজও শীতল পাটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন এ অঞ্চলের পাটি শিল্পীরা। এ উপজেলার শিল্পীরা অনেক দরদ দিয়ে মনের সব রং ঢেলে নিপুণ হাতে তৈরি করেন আরামদায়ক ও টেকসই শীতল পাটি। বর্তমানে আধুনিকতার যাঁতাকল থেকে বেড়িয়ে এসে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াসে পুরো উদ্যম নিয়ে শীতল পাটির তৈরির কাজ করছেন এ অঞ্চলের পাটিকররা। এ উপজেলার শীতল পাটি গুণে মানে অনন্যা হওয়ায় নজর কাড়ছে বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন শপে। সেখান থেকে পছন্দসই শীতল পাটি সংগ্রহ করছে ক্রেতারা। এ ছাড়া উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের হিংগানগর কামান্নাপাড়া লোকনাথ মন্দির এলাকায় সপ্তাহে শুক্রবার ও মঙ্গলবার দুই দিন বসে পাটি বিক্রির হাট। এ হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাটি কিনতে আসেন ব্যসায়ীরা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের হিংগানগর, গোমজানি ও এলাসিন ইউনিয়নের সিংহরাগী গ্রামসহ কয়েকটি গ্রামে ঘরে ঘরে চলছে পাটি বুননের কাজ। পাটিকর তাদের দক্ষ হাতের গাঁথুনি দিয়ে অনেক আকর্ষণীয় করে তৈরি করছে প্রতিটি পাটি। এসব পাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো এক ধরনের গুন্ম বা মুত্রা জাতীয় উদ্ভিদ। পাটি তৈরি করা হয় বলে ওই উদ্ভিদটি এ অঞ্চলে পাটিবেত হিসেবে পরিচিত লাভ করে। এ অঞ্চলের পাটিশিল্পের বিশাল এলাকাজুড়ে দেখা যায় পাটিবেতের চাষ। এসব পাটি বেত প্রক্রিয়াজাত করে পাটি তৈরির জন্য উপযোগী করে দেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। পাটি তৈরির মূল কারিগর হলেন পরিবারের নারী সদস্যরা। নারীরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পাটি বুননের কাজ করেন। পাটি বুননের পাশাপাশি সাংসারিক কাজকর্মও করেন তারা। ফলে প্রতিটি পাটি তৈরি করতে একজন নারীর সময় লাগে ৩ থেকে ৭ দিন। এসব পাটির বেশিরভাগই উন্নতমানের শীতল পাটি। আর এসব শীতল পাটির চাহিদা সারাবছর থাকলেও গরমে চাহিদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সে সময় শীতল পাটির জোগান দিতে দিন-রাত কাজ করেন পাটিকররা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৫ হাজার পরিবার এই পাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। আধুনিক যুগে পাটির শিল্পের দুর্দিনে অনেকেই পেশা বদল করেছে বলেও জানা গেছে। তবে আটিয়া ইউনিয়নের বৃহত্তর হিংগানগর গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় সব চেয়ে বেশি পাটি তৈরি হয় বলে হিংগানগর গ্রাম ঘিরে গড়ে উঠেছে পাটি হাট। সপ্তাহে শুক্রবার ও মঙ্গলবার দুই দিন বসে পাটি হাট। এ অঞ্চলের পাটিকররা তাদের পাটির পসরা সাজিয়ে বসেন হাট এলাকায়। হিংগানগর কামান্নাপাড়া গ্রামের পাটি শিল্পী বেলা রানী দে (৬৫) ও চন্দনা রানী দে (৩২) জানান, 'পরিবারের পুরুষ সদস্যরা শুধু পাটিবেত কেটে বেতি তৈরি করে দেন। পরে নারীরা বেতিতে রং দেওয়াসহ পাটি বুননের সব কাজ করে থাকেন।' একই গ্রামের জুরান চন্দ্র দে (৫২), কেশব চন্দ্র দে (৭০) ও গোপাল চন্দ্র দে (৫৩) জানান, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পাটি বেত সংগ্রহ করে বেত থেকে বেতি তৈরি করে থাকে। পরে নারীরা পাটি তৈরি করে দিলে তা হাটে নিয়ে বিক্রি করে দেন। বর্তমানে তাদের কাছ থেকে পাটি কিনে অনেকেই অনলাইনে শপে উচ্চমূল্যে ব্যবসা করেন বলেও জানান তারা। তারা আরও বলেন, আধুনিক যুগে শীতল পাটির কদর কমে যাওয়া এ পেশা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় এ শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতা কামনা করছেন তারা।