অসময়ে বাজার ধরতে আনারসে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক

টার্গেট রোজার বাজার ও অধিক লাভের আশা

প্রকাশ | ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
টাঙ্গাইলের মধুপুরে লাভের আশায় একটি আনারস ক্ষেতে রাসায়নিক স্প্রে করছেন কৃষকরা -যাযাদি
রসালো ফল আনারসের রাজধানী টাঙ্গাইলের মধুপুর। মধুপুর ছাড়াও টাঙ্গাইলের ঘাটাইল ও সখীপুর উপজেলায়ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আনারসের আবাদ হয়। এসব এলাকায় মূলত ক্যালেন্ডার ও জলডুগি এ দুই ধরনের আনারসের আবাদ করেন কৃষকরা। কয়েক বছর ধরে থাইল্যান্ডের এমডি-টু জাতের আনারসেরও চাষ করা হচ্ছে। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে এগুলো বাজারজাত হয়। তবে পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে মার্চ মাসেই বাজারে মিলছে জলডুগি আনারস। জানা যায়, অতি মুনাফালোভী কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে অসময়ে এ জাতের আনারসকে পাকিয়ে বাজারজাত করছেন। এতে ভিটামিন ও খনিজ লবণসমৃদ্ধ এই ফলকে 'বিষে' পরিণত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা আনারস খেলে মানুষের শরীরে অ্যালার্জি, চর্মরোগ থেকে শুরু করে ক্যান্সারও বাসা বাঁধতে পারে। স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারস আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে ৩২৪ হেক্টরে জলডুগি এবং ৬ হাজার ৫১০ হেক্টরে ক্যালেন্ডার প্রজাতির আনারস। এছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে কয়েক বছর ধরে চাষকৃত থাইল্যান্ডের এমডি-টু জাতের আনারস ৬ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে। সূত্রমতে, প্রাকৃতিকভাবে আনারস গুটি ধরা থেকে পাকা পর্যন্ত ৬ থেকে ৭ মাস সময় লাগে। জলডুগি আনারস চারা রোপণ থেকে পাকা পর্যন্ত ১২ মাস সময় লাগে। আনারস জুন-জুলাই মাসে বাজারে আসার কথা থাকলেও এ বছর মার্চেই বিক্রি শুরু হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অতি মুনাফালোভী কৃষক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা মিলে রাসায়নিক দিয়ে আনারসের চারায় গুটি ধরা, বড় করা ও পাকানোর কাজটি করছেন। সাধারণত আনারসের চারায় ৪৫ পাতা হওয়ার পর গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কিছু কৃষক চারায় ১২-১৫ পাতা হওয়ার পরই গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করছেন। এছাড়া কৃষি বিভাগ থেকে ১৬ লিটার পানিতে ১৬ মিলিগ্রাম রাসায়নিক মিশিয়ে চারায় স্প্রে করার পরামর্শ দিলেও কৃষকরা ১৬ লিটারে দুই থেকে তিনশ' মিলিগ্রাম রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। সরেজমিন মধুপুর উপজেলার ইদিলপুর, কুড়িবাড়ি, হাগুড়াকুড়ি, শোলাকুড়ি, ঘুঘুর বাজার, গায়রা গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন বাগানেই দেখা যায়, শ্রমিকরা আনারসে রাসায়নিক ছিটাচ্ছেন। কৃষক ও শ্রমিকরা জানান, ক্ষেতের আনারস দ্রম্নত পাকানোর জন্য শুধু ইথোপেন রাসায়নিক স্প্রে করা হচ্ছে। ইদিলপুরের আনারস চাষি সুকুমার জানান, আনারসের চারা বড় হলে গাছের মাথায় গর্ভবতী (রাসায়নিক) দিলে কয়দিন পরেই সব গাছে গুটি ধরে। যে গাছে ধরে না সেটাতে আবার গর্ভবতী দিলেই গুটি বের হয়। ১৫-১৬ দিন পরপর দুই-তিনবার হরমোন দিলেই আনারসের আকার দ্রম্নত বাড়ে। এরপর ক্ষেতের ফল পাকানোর ওষুধ দিলে সবগুলো একসঙ্গে পাকে। তখন ক্ষেত থেকে আনারস কেটে বিক্রি করা যায়। কুড়িবাড়ি এলাকায় কর্মরত শ্রমিক হায়দার আলী জানান, কৃষি বিভাগের কথা মানলে ক্ষেতের আনারসের ভালো দাম পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে। তাই ভালো দাম পেতে ক্ষেতের আনারস দ্রম্নত বড় ও পাকানোর জন্য ১৬ লিটার পানির কন্টেইনারে ২-৩ বোতল রাসায়নিক মিশিয়ে স্প্রে করছেন। এখন যেগুলোতে স্প্রে করা হচ্ছে সেগুলো আগামী এক সপ্তার মধ্যে দারুণ কালার হয়ে পেকে যাবে। কয়েকদিন আগে যে আনারসে ওষুধ দেওয়া হয়েছে সেগুলো ক্ষেত থেকেই পাইকাররা কিনে নিচ্ছেন। আনারস ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি ৯০ লাখ টাকা দিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার আনারস কিনেছেন। ঢাকা, চাটমোহর, উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলায় সেসব আনারস বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি জলডুগি আনারস ক্ষেতেই ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। রোজা শুরু হলে আনারসের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তখন ক্ষেতেই প্রতিটা ৩০-৩৫ টাকা দরে বিক্রি হবে। স্থানীয় কৃষি অফিসের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে মধুপুরে ২৬টি পাইকারি ও ১৬২টি খুচরা রাসায়নিক বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠান আছে। দেশি, বিদেশি ও স্থানীয় ৭০টি কোম্পানির রাসায়নিক আনারসের রাজধানী মধুপুর উপজেলায় বিক্রি হয়। নাম প্রকাশ না করে মধুপুর উপজেলা পেস্টিসাইড অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, চলতি মৌসুমে মধুপুর উপজেলায় সব কোম্পানি মিলিয়ে ৭৫ কোটি টাকার রাসায়নিক বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক কৃষিবিজ্ঞানী ডক্টর আবু হাদী নূর আলী খান জানান, আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ লবণ থাকে। রসালো ফল আনারসে অতিমাত্রায় বিভিন্ন নামের রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। হরমোন বা ইথোপেন নামক রাসায়নিক মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ভারত ও চীন থেকে এগুলো আসে। বাংলাদেশে যখন এই রাসায়নিক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয় তখন তারা অনুমোদন না দেওয়ার জন্য আপত্তি জানিয়েছিলেন। মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, কৃষকদের অনুমোদিত রাসায়নিক প্রতি লিটারে এক মিলিমিটার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কোম্পানির লোকের পরামর্শে ক্ষেতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করেন। টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) দুলাল উদ্দিন জানান, মধুপুরের আনারস দেশ-বিদেশে সমাদৃত। কোম্পানির লোকদের কুপরামর্শে কতিপয় চাষি অতিলোভে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে আনারসের স্বাদ ও ঐতিহ্যের ক্ষতি করছেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাদের সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগের পরামর্শসহ সব রকম সহযোগিতা করা হয়। তবে সবার সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।