তারা কাজ করেন সমান, মজুরি পান পুরুষের চেয়ে কম!
প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মন্তোষ চক্রবর্তী, হাওড়াঞ্চল (কিশোরগঞ্জ)
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা এবং পার্শ্ববর্তী উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাওড়াঞ্চলে মজুরি বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার নারী শ্রমিক। কৃষিনির্ভর যে সভ্যতা মানুষ প্রথম প্রবর্তন করে তাতে প্রধান অবদান ছিল নারীর। এক সময় কৃষকের ভূমিকায় পুরুষরা অধিষ্ঠিত হলেও তাতে কৃষিকাজ থেকে নারীর পুরোপুরি বিচু্যতি ঘটেনি। বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনে নারী-পুরুষ শ্রম বিভাজনের পরিবর্তন আসছে। পুরুষ কাজ ছেড়ে গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছেন। এতে কৃষি কাজে নারীদের দায়িত্ব বাড়ছে। তবে বাড়েনি মজুরি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোদ, বৃষ্টি-ঝড়, শীত ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে এসব নারী শ্রমিক সারাদিন কাজ করেন। কিন্তু পুরুষদের সমান কাজ করেও তাদের দৈনিক মজুরি কখনো পুরুষদের অর্ধেক, কখনো অল্প কিছু পেয়ে থাকেন। সরকারি বা স্থানীয়ভাবে বঞ্চিত এসব নারী শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে বা মজুরি বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ গ্রহণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।
সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার সংযোগস্থল এক ফসলি বোরো উৎপাদনী এই বিস্তীর্ণ হাওড়াঞ্চলে বর্ষার ৬ মাস কাজ থাকে না। এছাড়াও এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই শ্রমজীবী খেটে খাওয়া শ্রেণির। বেশিরভাগ শ্রমিকই বোরো উৎপাদন, রোপণ, বাছাই, নিরানী, সার দেওয়া, ধান কাটা-মাড়াই এবং কৃষকদের গোলায় কাজ করার মাধ্যমে মজুরি বিক্রি করেন।
অষ্টগ্রামের বড় হাওড়, শিয়াল ডাঙ্গা, চৌদন্ত বস্তি, ভাটিনগর, শরীফপুর, ভাতশালা, কাকুরিয়া, চন্ডীপুর হাওড়, বাজিতপুরের হুমায়ুনপুর, আছানপুর দিঘীরপাড়, কামরবাওলীর হাওড়, আজমিরীগঞ্জর পাহাড়পুর, বদলপুর হাওড়, লাখাই মাহমুদ পুরহাওড় বামৈর হাওড়, নাসিরনগরের গোয়ালনগর, চাতলপাড়, নোয়াগাঁও ইত্যাদি হাওড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে- অসংখ্য নারী শ্রমিক ফসলি জমি, সড়ক নির্মাণ ও খামারে কাজ করছেন। বর্তমান এই অঞ্চলের সরকারি কাজ জোগালি, নির্মাণ, মাটি ভরাট কোনো কোনো ইউনিয়নে কাঁচা সড়ক সংস্কারে নারীদের কাজ করতে দেখা যায়।
একাধিক নারী দিনমজুর জানান, বাড়ি থেকে নদী পাড় হয়ে ৫-৭ মাইল দূরে গিয়েও কখনো কখনো কাজ করতে হয়। মাঝে মধ্যে পাশবিক লালশাসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হন। তখন মজুরি না পাওয়ার মত ঘটনার অসংখ্যা দৃষ্টান্ত রয়েছে। এসব উপক্ষো করে সন্তান ও পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতে গিয়ে মজুরি বিক্রি করে যাচ্ছেন তারা।
তারা আরও জানান, বেসরকারি এনজিওতে কাজ করেও সমান মজুরি বঞ্চিত হয়েছেন। যেখানে পুরুষদের দৈনিক মজুরি ৬শ' টাকা সেখানে নারী শ্রমিকদের ৩শ' থেকে ৪শ' টাকা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে তাদের প্রতিবাদ করার উপায় নেই। এসব হাওড়াঞ্চলে নারী নেতৃত্ব বিকাশে কোনো নারী সংগঠনও গড়ে উঠেনি। হাওড়াঞ্চলের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর কাজ হলেও নারীদের কাজ করার মতো কোনো কুটিরশিল্প বা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড় উঠেনি।
ইটনা উপজেলা ধনপুর গ্রামের সুরেখা দাস (৪০), মৃগা গ্রামের পেশু বেগম (৩৫) ও অষ্টগ্রাম উপজলার কলমা ইউনিয়নের সাপান্ত গ্রামের দূর্গা রানী দাসসহ অসংখ্যা নারী শ্রমিক জানান, সারাদিন কাজ করে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরি পান।
এ ব্যাপার পরিবেশবাদী ও হাওড়াঞ্চলবাসী ঢাকা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রোটারিয়ান কামরুল হাসান বাবু বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী নারী কিংবা পুরুষ সমান, সমঘণ্টা কাজ করলে তার সমপরিমাণ মজুরি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এতে যদি কম দেওয়া হয় তাতে রাষ্ট্রীয় শ্রম আইন লঙ্ঘন এবং এটি আইনবহির্ভূত হবে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোর হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।