রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের অদূরে ছোটবড় উঁচু নিচু পাহাড়ি জনপদ বেষ্টিত গুলশাখালী। এই ইউনিয়নের লোহাকাঠ বাগানটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। ঝিরির অববাহিকায় নির্মল বাতাস, সবুজে ঘেরা গাছপালা, বন্যপ্রাণীদের আনাগোনা যেন নৈসর্গিক দৃশ্য।
তবে এই নৈসর্গিকতা যেন সহ্য হচ্ছে না স্বার্থান্বেসী একটি মহলের। যারা রাতের আঁধারে এই বনের গাছ কেটে উজাড় করতে ব্যস্ত। ফলে একদিক দিয়ে ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ি বন তেমনি নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
জানা গেছে, গত ২২ ফেব্রম্নয়ারি দিবাগত রাত ২টার দিকে বন বিভাগের একটি লোহাকাঠ বাগানে গাছ কাটার ঘটনা ঘটেছে। উপজেলার গুলশাখালী ইউনিয়নের ১১ নম্বর কলাবাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আর এই ঘটনার পেছনে গুলশাখালী মৌজার হেডম্যান আব্দুল হালিমকে দায়ী করছেন অনেকে। এ ঘটনায় আটজনকে অভিযুক্ত করে থানায় অভিযোগও করা হয়।
অভিযুক্তরা হলেন ৩৮৬ নম্বর গুলশাখালী মৌজার হেডম্যান মুর্শিদাবাদ এলাকার নাজিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুল হালিম (৫০), একই ইউনিয়নের আহসানপুর এলাকার আলী হোসেনের ছেলে মো. শাকিল (২৫), রাজনগর এলাকার বারেক মেম্বারের ছেলে মো. আবির (২৬) এবং গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মো. সাগর (২৬), সোনারগাঁও এলাকার জালাল উদ্দীনের ছেলে মো. আমিনুল (২৮), ১১ নম্বর এলাকার কালু মোলস্নার ছেলে মো. দেলোয়ার (৪০), বগাচতর ইউনিয়নের গাউসপুর এলাকার কবির হোসেনের ছেলে মো. ইকবাল (২৫) ও সামছুউদ্দিনের ছেলে আলা উদ্দিন (৩০)
প্রত্যক্ষদর্শী কাজী মাইনুদ্দীন জানান, 'বৃহস্পতিবার রাতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন লোক গাছ কাটার দেশীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে অবৈধভাবে বন বিভাগের গাছ কাটতে দেখি। আমরা বাধা দিলে আমাদের ওপর চড়াও হয়। গাছ কাটতে না দিলে মামলা দিয়ে হয়রানি করবে বলেও হুমকি দেয় তারা।'
স্থানীয় ইউপি সদস্য সিদ্দিক মেম্বার জানান, 'সাংবাদিকের কলে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে আসি। তারপর স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি হেডম্যানের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটেছে। পরে স্থানীয়দের মধ্য থেকে বন বিভাগের রাঙ্গীপাড়া বিট অফিসে যোগাযোগ করি।'
এলাকাবাসী বলছেন, উপজেলার সবুজ বেষ্টনী রক্ষায় বন বিভাগের কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত। এখনই যদি এই বনরক্ষা করা না যায়, তাহলে ঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সরেজমিনে বনের ভেতরে দেখা যায়, কেটে ফেলা গাছের গোড়া পড়ে রয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা অনেক গাছ করাত দিয়ে কিছু কিছু অংশ কেটে রাখা হয়েছে। রাতেই বাগানের প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি লোহাকাঠ গাছের চার তৃতীয়াংশ কেটে রেখে যান দুষ্কৃতকারীরা। যা ঝোড়ো হাওয়ায় যেকোনো সময় পড়ে যাবে গাছগুলো। এতে ঘটতে পারে প্রাণহানিও।
এ বিষয়ে রাঙ্গীপাড়া অফিসের বিট কর্মকর্তা ওমর ফারুক চৌধুরী থানায় এজাহারের বরাতে বলেন, 'গোপন সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি ২০ থেকে ২৫ জন লোক দেশীয় অস্ত্রসহ সরকার সংরক্ষিত লোহাকাঠ বাগান এলাকায় জবর দখলের উদ্দেশে ৬০টি লোহাকাঠ গাছ করাত দিয়ে কাটার অপচেষ্টা করছে। আমরা প্রতিহত করার চেষ্টা করলে অকথ্য ভাষায় গালাগালসহ অস্ত্রসাজে তেড়ে আসে। আমরা ভয়ে স্থানীয় মেম্বার ও সাধারণ জনগণকে মোবাইল ফোনে জানালে ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলামসহ অন্যরা আমাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে লংগদু থানায় ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি।'
তবে সবকিছু উড়িয়ে দিয়ে বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অপপ্রচার বলে দাবি করে হেডম্যান আব্দুল হালিম বলেন, 'ঘটনার সময় আমি রাজনগর বিজিবি জোনে ছিলাম। আমাকে স্থানীয়রা জানালে আমি জোন অধিনায়ককে অবগত করে ঘটনাস্থলে আসি এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'লোহাকাঠ বাগানের জায়গার রেজিস্ট্রি আমি কিনে নিয়েছি। এটা আমার জায়গা। আর গাছগুলো বন বিভাগের।'
এদিকে জায়গার সম্পূর্ণ বৈধ দলিলাদি রয়েছে বলে দাবি করা মালিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'জায়গা আমার। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে হেডম্যান হালিম তার জায়গা বলে দাবি করে সেটা অজানা। তবে হেডম্যান হালিম কয়েক বছর আগে এ জায়গা কিনতে চেয়েছিলেন আমার কাছে। প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় যাব।'
এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের পাবলাখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা সজীব মজুমদার বলেন, অবৈধভাবে সংরক্ষিত বনের গাছ কাটায় বন বিভাগের নিয়মিত মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে থানায় এজাহার করা হয়েছে। আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুনুর রশীদ বলেন, বন বিভাগের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।