উত্তরে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান
বদলে যাবে দেশের ভাগ্যের চাকা
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
উত্তরের জেলাগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের বালিতে মহামূল্যবান ছয়টি খনিজ পদার্থের সন্ধান মিলেছে। গবেষণায় একটি সংস্থা বলেছে প্রতি ১ বর্গ কি.মি. ও ১০ মি. গভীরতায় মাইনিং কার্যক্রম ও পৃথকীকৃত মিনারেলের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ৩৬৩ মিলিয়ন ডলার বা ৩৬৩০ কোটি টাকা। শুধু কি ব্রহ্মপুত্রেই নাকি উত্তরের পদ্মা, যমুনাসহ অন্য অঞ্চলগুলোতেও এত সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলার স্বপ্নকে হাতছানি দিচ্ছে এসব অবহেলিত বালু।
বালুতে মহামূল্যবান সম্পদ লুকিয়ে আছে। তবে সরকারি-বেসরকারি নানা কুচক্রী মহলের সহযোগিতায় এসব বালু অবাধে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন রাস্তাঘাট, পুকুর জলাশয়, বিল্ডিং-বাড়িসহ ব্যক্তিগত ও সরকারি-বেসরকারি স্থানগুলোতে।
কোথায় কীভাবে লুকিয়ে আছে সম্পদ বলা মুশকিল। উত্তরের জনপদ কখনো কোনোভাবেই স্বপ্নেও ভাবতে পাড়েনি এসব মহামূল্যবান সম্পদের কথা। পায়ের নিচে পড়ে আছে হাজার হাজার কোটি টাকার রত্ন। কোনোভাবেই অনুভব করতে পারা যায়নি। আমাদের চিরচেনা ব্রহ্মপুত্র নদ বর্ষায় টইটুম্বর আর শুস্ক মৌসুমে কেবলি ধু-ধু বালি চর ও বড় বড় বালির স্তূপ। পানিতে ভিজে থাকা, ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে যাওয়া, চরাঞ্চলের মানুষগুলোর পায়ে নিচে দলিত হয়ে আবার কখনো কখনো বিরক্তির ঝরে মানুষগুলোর অতিষ্ঠতা, অথবা বন্যার পানিতে একূল-ওকূল গড়াগড়ি করা, আবার ছোট ছোট শিশুর চোখে চিকিমিকি বালির কণাগুলোতেই লুকিয়ে আছে এসব মহামূল্যবান সম্পদ। তাও আবার মহামূল্যবান ৬টি খনিজ পদার্থ। এমন কল্পনা উত্তরের সাধারণ মানুষতো নয়ই, গবেষকরাও কখনো কল্পনা করেননি। সেই বালিই এখন দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করতে হাতছানি দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেড নামক অস্ট্রেলিয়ার একটি কোম্পানি উত্তরের জেলা গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসীঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের বালুচরে এক্সপেস্নারেশ কাজ সম্পন্ন করেছে এবং মাইনিং লাইসেন্স প্রাপ্তি ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ব্রহ্মপুত্র নদের এমন গুপ্তধন নিয়ে অনুসন্ধান করেন যায়যায়দিনের এই প্রতিবেদক। সেখানে উঠে আসে অবহেলিত এলাকায় সন্ধান মেলা খনিজ পদার্থের বিস্তারিত। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাগারেও পদচারণা ছিল কয়েক সপ্তাহ ধরেই। অক্লান্ত পরিশ্রম আর নানা জটিলতা পেরিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রতিবেদনটি।
বালির নিচে লুকিয়ে থাকা এসব খনিজ পদার্থ হচ্ছে- ইলমেনাইট, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, গারনেট ও কোয়ার্টজ অন্যতম। এসব খনিজের মধ্যে জিকরন সিরামিক, টাইলস, রিফ্যাক্টরিজ ও ছাঁচ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। রং, পস্নাস্টিক, ওয়েলডিং রড, কালি, খাবার, কসমেটিকস, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় রুটাইল। সিরিশ কাগজ উৎপাদনে ব্যবহার হয় গারনেট। চুম্বক, ইস্পাত উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে লাগে ম্যাগনেটাইট। টিটেনিয়াম মেটাল, ওয়েল্ডিং রড ও রং উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় ইলমেনাইট। আর কাঁচ শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল কোয়ার্টজ।
গবেষণায় শনাক্তের পর 'ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জি' (আইএমএমএম) বলেছে প্রতি এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের দাম ৩ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের বালিতে প্রচুর পরিমাণে এসব খনিজ সম্পদ আছে নিশ্চিত করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। খনিজ সম্পদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জির সদ্য বিদায়ী পরিচালক ড. মোহাম্মদ নাজিম জামান যায়যায়দিনকে জানান, 'কুড়িগ্রাম অংশে ব্রহ্মপুত্র নদের বালিতে পাওয়া গেছে ইলমিনাইট, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, গারনেট ও কোয়ার্টজের মতো মূল্যবান ছয়টি খনিজ। এখানকার বালিতে আরও খনিজ শনাক্তের কাজ করছেন গবেষকরা'।
ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদের বিভিন্ন চরের খনিজ বালু নির্মাণ ও পূর্ত কাজের আওতায় ব্যবহার করে সর্বোচ্চ রাজস্ব আয় হচ্ছে ৮০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে- যদি ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারি এলাকায় দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক আনুমানিক ১৫০০ কোটি ব্যয়ে খনিজ বালু প্রসেসিং সেন্টার স্থাপন করা হয় সেখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ মেট্রিক টন খনিজ পাওয়া সম্ভব। যা ১০ বছরের মধ্যে মূলধন উঠে আসবে এবং ২২০০ জনবলের কর্মসংস্থান হবে এবং লাভজনক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা হবে।
ইতোমধ্যে এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেড নামক অস্ট্রেলিয়ার একটি কোম্পানি গাইবান্ধা এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের বালুচরে এক্সপেস্নারেশ কাজ সম্পন্ন করেছে এবং মাইনিং লাইসেন্স প্রাপ্তি ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।
সূত্র থেকে জানা যায়, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন বালুচর থেকে ১ হাজার ৫শ' টন বালু সংগ্রহ করা হয়। খনিজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতি টন বালি থেকে ২ কেজি ইলমিনাইট, ২শ' গ্রাম রুটাইল, ৪শ' গ্রাম জিরকন, ৩.৮ কেজি ম্যাগনেটাইট, ১২ কেজি গারনেট ও ৫০ কেজি কোয়ার্টজ মিনারেল পাওয়া যায়। এই সম্পদ কীভাবে উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াজাত করা যায় তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টরা চিন্তা করছেন।
এদিকে এভারলাস্ট লিমিটেড নামের অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানিটি বেশ কিছু দিন ধরে গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের ৪ হাজার হেক্টর বালুচরে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের কাজ করছে। বালাসীঘাট এলাকায় একটি পস্নান্টও স্থাপন করছে প্রতিষ্ঠানটি। এবার ফুলছড়ির বালাসীঘাট, সদরের মোলস্নারচর এবং কামারজানি এলাকায় ২ হাজার ২৯৫ হেক্টর বালিচর লিজ চেয়ে খনিজ আহরণের আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে আহরণের পর সরকারকে ৪৩ ভাগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে তারা। তবে এ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
গবেষকরা বলছেন, ব্রহ্মপুত্র নদের অফুরন্ত এই সম্পদের বহুবিধ ব্যবহার যেমন সম্ভব, তেমনি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা। হতে পারে রপ্তানি আয়ও।
ড. মোহাম্মদ নাজিম জামান বলেন, 'কুড়িগ্রামে প্রবেশ থেকে ডাউনস্ট্রিমে গাইবান্ধা পর্যন্ত এবং তিস্তা নদীর অববাহিকায় যেসব চর, সেগুলো নিয়ে আমরা জিওফিজিক্যাল সার্ভে করি। কোন জায়গায় কোন ধরনের মিনারেলস আছে, এটার প্রাথমিক স্টাডি ২০১০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সম্পন্ন করা হয়। এটি কার্যকরী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী এই বিষয় পাইলটিং করার নির্দেশনা দেন। এর পর ২০১৭ সালে একটি এটিপি প্রকল্প নেওয়া হয়। সেই প্রকল্প অনুযায়ী জয়পুরহাটে একটি খনিজ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এখানে গবেষণা করে ব্রহ্মপুত্র নদে মূল্যবান খনিজগুলোর সন্ধান মেলে।'
বিষয়টি নিয়ে পরিচালক (যুগ্ম সচিব), খনিজ সম্পদ উন্নয়ন বু্যরো (বিএমডি) আবুল বাসার সিদ্দিক আকন একটি গণমাধ্যমকে বলেন, কোন প্রক্রিয়ায় কোন প্রতিষ্ঠান এসব খনিজ আহরণ করবে- শিগগিরই তা নির্ধারণ করবে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
এদিকে মহামূলবান খনিজ পদার্থের অস্তিত্ব মিললেও বালু দসু্যরা এখনো অবাধে ব্রহ্মপুত্র নদের ভিন্ন পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন করেই চলছে। প্রশাসেনর পক্ষ থেকেও বালু উত্তোলন রোধ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময় লোক দেখানো দু-একটি অভিযান পরিচালনা করলেও নামমাত্র অর্থ জরিমানা করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার কোলঘেষে রয়েছে প্রায় কয়েকশ' বালু ব্যবসায়ী। তারা বেশিরভাগই রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি।