বগুড়ায় প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়ম ও অমানবিকতায় অতিষ্ঠ নারী শিক্ষকরা

প্রকাশ | ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়ম, অমানবিকতা ও অশ্লীল কথাবার্তায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বিদ্যালয়টির শিক্ষকেরা। বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার জোড়গাছা ইউনিয়নের হলিদাবগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গওছেল আজম লিটু নামের একজন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ দিয়েছেন ওই প্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষকরা। অভিযোগে জানা যায়, ওই বিদ্যালয়ে গওছেল আজম লিটু প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষকরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা ধরনের অভিযোগ ও অনিয়মের ফিরিস্তি। এগুলোর মধ্যে স্স্নিপ ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ, প্রশংসাপত্র দেওয়ার নামে শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে টাকা উত্তোলন, বিজয় দিবসহ অন্য দিবসগুলোর নামে বরাদ্দের অর্থ, পুরাতন ভবনের লোহার অ্যাংগেল বিক্রির অর্থ, গত দুই বছরে আন্তঃক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও জাতীয় শিক্ষা পদকের বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ, সততা স্টোরের নামে দোকান দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণার ব্যবসা, প্রধান শিক্ষকের দোহাই দিয়ে ক্লাস না নেওয়া, পরপর ৪ দিন বিদ্যালয়ে না এসে এক দিনেই সবগুলো হাজিরা স্বাক্ষর করাসহ নানা ধরনের অনিয়ম করা ইতোমধ্যে তার রুটিন হয়ে গেছে। শিক্ষকদের দাবি সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক যেকোনো সময় বসে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিজেদের মনগড়াভাবে নিয়ে থাকেন। এসব নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বিদ্যালয়টির অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও এলাকাবাসী। ইতোমধ্যে চাপের মুখে বিদ্যালয়ের সভাপতি আলপনা খাতুন পারিবারিক কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা অফিসে। উলেস্নখ্য, সভাপতি আলপানা খাতুন ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রাসেল মাহমুদের স্ত্রী। অভিযোগগুলো করেন শিক্ষিকা রাজিয়া সুলতানা স্মৃতি, মাহমুদা খাতুন ও মোছা. নুরানি বেগম। সহকারী শিক্ষক রাজিয়া সুলতানা স্মৃতি এ বিষয়ে বলেন, 'প্রধান শিক্ষকের মানসিক টর্চারে আমরা অতিষ্ঠ। তার কাছে ছুটি নিতে গেলে মেয়েদের গোপন বিষয়গুলো খুলে বলতে বাধ্য করেন। ওই সময় আমাদের অন্যসব শিক্ষকদের সামনেই এসব নানা কথা আলোচনা করে অপমান অপদস্ত করেন।' একই ধরনের কথা বলেন মাহমুদা খাতুন ও নুরানি সুলতানা। নুরানী সুলতানা বলেন, 'তার অশ্লীল ও আজেবাজে কথা ও অসৌজন্যমূলক আচরণ আমাদের অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আমার বিরুদ্ধে অহেতুক অভিযোগ এনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মানসিক টর্চারের পরিধি চরমে নিয়ে গেছেন।' এই শিক্ষিকা আরও বলেন, 'প্রধান শিক্ষক আমাকে একাধিকবার বলেছেন যে, এখানে চাকরি করলে স্বামী দুইটা মানতে হবে।' বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শৌখিনুজ্জামান বলেন, 'আমার বাবা প্যারালাইসিসের রোগী। আমি বগুড়া শহরে থাকি। আমার বাবা শুধু আমাকে দেখার জন্য প্রতিদিন অতি কষ্ট করে বিদ্যালয়ের গেটে এসে খবর পাঠাতেন। আমি গেটে গিয়ে তার সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলে হাতে কিছু টাকা দিতাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন প্রধান শিক্ষক আমাকে ডেকে বলেন, 'তোমার বাবা দেখা করতে আসলে সপ্তাহে একদিন আসতে পারবে, তার বেশি নয়।' এরপর থেকে বাবা আর বিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি।' সহকারী শিক্ষক রাঙ্গা মিয়া বলেন, আমার দাদির মৃতু্য হলে বিষয়টি স্যারকে জানাই। কিন্তু তিনি বলেন, 'দাদির মৃতু্য হয়েছে তাতে কি হয়েছে। স্কুলে আসেন সময়মতো গিয়ে মাটি দিয়ে আসিয়েন। কোনো কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।' ২০২৩ সালে হানিফ নামের এক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অহেতুক অভিযোগ তুলে বেধড়ক মারধর করেন ওই প্রধান শিক্ষক। এতে ওই শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সোনাতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি করা হয়েছিল। উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টার আবু সাঈদ মো. শফিউল ইসলাম বলেন, 'প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলোর অনেকটাই আমি জানি, যেমন হানিফ নামের শিক্ষার্থীকে মারধরের বিষয়টি সঠিক। তবে আমি ওই ক্লাস্টারের কর্মকর্তা হলেও আমাকে না জানিয়ে আমার তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা ও অন্য মহলকে জানিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়েছিলেন। এছাড়া সততা স্টোরের নামে যে ব্যবসা, শিক্ষিকাদের অশ্লীল কথা বলার বিষয়টি সঠিক।' এই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার কেনার টাকা আত্মসাৎসহ আরও বেশকিছু বিষয়ে মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। এগুলো খতিয়ে দেখে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।' উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এনায়েতুর রশীদ বলেন, 'বিভিন্ন সময় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মৌখিক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়গুলো তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।' এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, 'বিষয়গুলো আমি অবগত নই, আগে জেনে নিই।' বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গওছেল আজম লিটুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান যথাযথভাবেই পালন করা হয়। তবে পুরস্কারগুলো অনেক সময় দেরিতে বিতরণ করা হয়েছে। প্রত্যয়ন পত্রের জন্য টাকা নেওয়া হয়। কারণ বিদ্যালয়ের কিছু খরচ সরকারিভাবে পাওয়া যায় না। সে কারণে বিভিন্ন সময় টাকা নেওয়া হয়।' শিক্ষিকাদের অভিযোগগুলো তিনি কিছুুটা স্বীকার করেন এবং কিছু অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'ছুটি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় কি ধরনের অসুস্থতা তা শুনতে চাওয়া হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের ভেতরের অনেক বিষয় থাকে।'