সূর্যমুখীর হলুদ হাসিতে স্বপ্ন বুনছেন কৃষক
প্রকাশ | ০৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
চলতি মৌসুমে বিভিন্ন স্থানে এবার সূর্যমুখী ফুলের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফুটে থাকা হলুদ সূর্যমুখী ফুলের সমাহারে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা। যেদিকে চোখ যায় শুধু হলুদ ফুলের হাসি। সেই হাসিতে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন সূর্যমুখী চাষিরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রথাগত ধান-পাট, গম-ভূট্টা, আখ চাষাবাদের পাশাপাশি বিকল্প চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। চলতি রবি মৌসুমে বিভিন্ন ডাল, সবজি ও ডাল চাষের সঙ্গে তেলবীজ সূর্যমুখী চাষে আগ্রহ বেড়েছে তাদের। বিভিন্ন এলাকার মাঠজুড়ে এখন কেবল হলুদের সমারোহ। সবুজ গাছের ডগায় হলুদ সূর্যমুখী ফুল দোল খাচ্ছে বাতাসে। সৌন্দর্যের এই সূর্যমুখী ফুলেই রয়েছে বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা। মাঠজুড়ে সূর্যমুখীর হলদে আভায় বিমোহিত দর্শনার্থীরাও। গোবিন্দগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে সূর্যমুখীর আবাদ। ধান, ভুট্টা, বাদাম, আলু ও টমেটোর মতো অর্থকরী ফসল হিসেবে সরকার সূর্যমুখী চাষে উৎসাহ দিচ্ছেন। এ কারণে সূর্যমুখী চাষও বাড়াচ্ছেন চাষিরা। তাই বাড়ছে সৌন্দর্যে ভরা আর অর্থকরী তৈলবীজ সূর্যমুখী চাষের এলাকা।
উপজেলার কাটাবাড়ি, রাজাহার, পৌরসভার কিছু এলাকাসহ এবার বেশ কিছু জমিতে চাষ হয়েছে সূর্যমুখীর। উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, গাইবান্ধার বিভিন্ন চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় সূর্যমুখীর চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অন্য ফসলের তুলনায় এটি খুবই লাভজনক। এ বছর কৃষি পুনর্বাসন প্রণোদনার আওতায় জেলায় ৫৬০ জন কৃষককে বিনামূল্যে দুই কেজি করে সূর্যমুখীর বীজ এবং ২৫ কেজি করে সার বিতরণ করা হয়। এ বছর জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ৭৬ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। ফলনও বেশ ভালো। এ থেকে ১৬০ মেট্রিক টন সূর্যমুখী তেলের বীজ পাওয়ার আশা করছে কৃষি বিভাগ। যার বাজার মূল্য প্রায় কোটি টাকা। গত বছর গাইবান্ধায় ৭৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা সূর্যমুখী ফুল চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। উৎপাদন সুবিধা ও বাজারদর বিবেচনায় বর্তমানে অনেক কৃষকই সূর্যমুখী চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
উপজেলার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের বাগদা এলাকার কৃষক মনসুর আলী জানান, তিনি চলতি বছর ৩ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করছেন। আগে এসব জমিতে বিভিন্ন সবজি চাষ করতেন। এবারই প্রথম কৃষি বিভাগের সহায়তায় সূর্যমুখী ফুল চাষ করছেন। ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ গাছে ফুল ফুটেছে। কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে তেলের বীজ এবং তেল- যেটি বিক্রি করলে লাভবান হবেন, সেটিই বিক্রি করবেন বলে জানান তিনি। এবার ফলন ভালো হলে প্রতিবছরই সূর্যমুখী ফুল চাষ করবেন।
উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শ্যামল কুমার বর্মণ জানান, ডিসেম্বর মাস থেকে কৃষকরা জমিতে সূর্যমুখী ফুলের বীজ রোপণ শুরু করেন। রোপণের দুই মাস পর গাছে ফুল ফোটে। আর ফোটার পর ফুল পরিপক্ক হতে সময় লাগে অন্তত ১৫ দিন। আগামী এপ্রিল মাস থেকেই কৃষকরা তাদের ফসল ঘরে তুলতে শুরু করবেন।
সম্প্র্রতি কাটাবাড়ি ইউনিয়নের বাগদা বাজারের কাছের সরেজমিন কয়েকটি সূর্যমুখী ফুল বাগানে গিয়ে দেখা যায়, বাগানগুলোতে দর্শনার্থীরা সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্য দেখতে ভিড় করছেন। এসব দর্শনার্থীদের জন্য কিছুটা বিড়ম্বনায়ও পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। অনেক দর্শনার্থী বাগান থেকে ফুল ছিঁড়ে ক্ষতি করছেন ফসলের।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই-মাহমুদ বলেন, কৃষকদের সূর্যমুখী ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে প্রণোদনা হিসেবে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে। বীজ রোপণের পর থেকে আমরা নিয়মিত তদারকিও করছি। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার ফলনও ভালো হবে। বীজ আহরণ এবং তেল উৎপাদন এ বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, খুলনার পাইকগাছায় সূর্যমুখী চাষে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। এবার সূর্যমুখী ফুলের চাষ ভালো হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সূর্যমুখী চাষ করা জমিতে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে হলুদ রঙের ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণ আর মৌমাছিরা ছুটছে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে। এটি যেন ফসলি জমি নয়, এ এক দৃষ্টিনন্দন বাগান। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকনে শুধু প্রকৃতিপ্রেমীই নয় বরং যে কারো হৃদয় কাড়বে।
তবে সূর্যমুখী ফুল চাষের লক্ষ্য নিছক বিনোদন নয়। মূলত ভোজ্যতেল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য চাহিদা মেটাতে এ চাষ করা হচ্ছে। সাধারণ কৃষকদের সূর্যমুখী চাষে উদ্বুদ্ধ করতে উপজেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর দিয়েছে সার ও বীজ প্রণোদনা। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সূর্যমুখী চাষাবাদের জন্য উপযোগী। কম সময় ও অর্থ ব্যয় করে সূর্যমুখী আবাদের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলে থাকায় কৃষকরা সূর্যমুখী ফুলের বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, পাইকগাছায় চলতি মৌসুমে ২৯৫ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়েছে। উপজেলার কৃষকরা এফ-১ (হাইব্রিড) জাতের সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। ফুলের সৌন্দর্য দেখতে খামারে আসছেন দর্শনার্থীরা। অনেকে এটি চাষ করার পরামর্শও নিচ্ছেন। বর্তমানে একঘেয়েমি ধান চাষ করে কৃষকরা তেমন একটা লাভবান হচ্ছেন না। অন্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে বেশি লাভের প্রত্যাশা কৃষকদের। সূর্যমুখী চাষ করলে ফুল থেকে তেল, খৈল ও জ্বালানি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি বীজ থেকে কমপক্ষে আধা লিটার তেল উৎপাদন সম্ভব। প্রতি বিঘা জমিতে ৭ মণ থেকে ১০ মণ বীজ উৎপাদন হয়। তেল উৎপাদন হবে প্রতি বিঘায় ১৪০ লিটার থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত। প্রতি লিটার তেলের সর্বনিম্ন বাজার মূল্য ২৫০ টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয় সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
উপজেলার দেলুটি ইউনিয়ানে ৮০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়েছে। দেলুটি কৃষক শিবপদ মন্ডল বলেন, কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রথমবার দুই বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। প্রতিটি গাছেই ফুল ধরেছে। আশা করেছেন সূর্যমুখী চাষে সফলতা আসবে ও লাভবান হতে পারবেন।
উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুন্ড বলেন, সূর্যমুখী একদিকে মনোমুগ্ধকর ফুল, অন্যদিকে লাভজনক ফসল। কৃষকদের বিস্তারিত জানিয়ে সূর্যমুখী আবাদ করার পরিকল্পনা করেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দিকে সারিবদ্ধভাবে বীজ বপন করা হয়। এর ৯০-১০০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যায়। সামান্য রাসায়নিক সার ও দুইবার সেচ দিতে হয় এ ফসলে। প্রতি একর জমিতে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর এক একর জমির উৎপাদিত বীজ থেকে ৬০-৬৫ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। সূর্যমুখী গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ অসিম কুমার দাশ বলেন, উপকূলের লবণাক্ত এ উপজেলায় সূর্যমুখী ফুলের চাষ ভালো হয়েছে। সূর্যমুখীর বীজ থেকে যে তেল উৎপন্ন হয় তা স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্পন্ন। আগামীতে উপজেলায় সূর্যমুখী ফুলের চাষ ব্যাপক হারে সম্প্র্রসারিত হবে।
বাসাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, সরিষার চেয়ে সূর্যমুখী চাষে ফলন ভালো হওয়ায় প্রবাসফেরত কৃষক সোহরাব মিয়ার মুখে হাসির ঝিলিক। গত দুই বছর ধরে সূর্যমুখী চাষ করে সফলতা পাওয়ায় এবারও তিনি ৬০ শতাংশ জমিতে সূর্যমুখী আবাদ করেছেন। কৃষক সোহবার মিয়া টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাঞ্চনপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।
এদিকে, বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারিভাবে পরীক্ষামূলক শুরু হলেও এবার অনেক কৃষক বাণিজ্যিক ও নিজ উদ্যোগে সূর্যমুখী চাষ করেছেন। এবার বাসাইল উপজেলায় ৫০ বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে।
জানা যায়, সোহবার মিয়া সৌদি আরবে থাকাকালীন সময়ে প্রায় ১২ বছর ফুলের বাগানে শ্রমিকের কাজ করেছেন। এরপর প্রায় চার বছর আগে তিনি দেশে ফিরে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে প্রথমে ২৫ শতাংশ জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেন। প্রথম বছরেই সফলতা পান। এরপর দ্বিতীয় বছর ৪০ শতাংশ জমিতে চাষ করেন। এবার তিনি ৬০ শতাংশ জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছেন। এছাড়াও তিনি পাশাপাশি ধান, পেঁয়াজ, রসুন আবাদ করেন। এখন তার জমিতে সূর্যমুখীর বীজ এসেছে। আর মাত্র কয়েকদিন পরই তিনি বীজগুলো কেটে ফেলবেন। এই ৬০ শতাংশ জমিতে তার খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। তিনি ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার সূর্যমুখীর তৈল বিক্রির প্রত্যাশা করছেন।
কৃষক সোহরাব মিয়া বলেন, 'সরিষার আবাদ করলে ৬০ শতাংশ জমিতে ৫ মণ সরিষা পাওয়া যেত। আর এই জমিতে সূর্যমুখীর বীজ হবে প্রায় ১৫ মণ। সামনের বছর আরও বেশি জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করা হবে। আমি সূর্যমুখী চাষে আর্থিকভাবে সফলতা পেয়েছি।'
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেন, 'উপজেলায় সূর্যমুখীর আবাদ বাড়াতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। গত বছরের তুলনায় এবার উপজেলায় সূর্যমুখীর চাষ বেশি হয়েছে। সরিষার চেয়ে সূর্যমুখীর ফলন ভালো হয়।'
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, গত অর্থ বছরে উপজেলায় ৫০ জন কৃষককে এক কেজি করে সূর্যমুখীর বীজ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সারও বিতরণ করা হয়। এবার উপজেলায় ৫০ বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।