কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে সময় পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি বাঁধের কাজ

শান্তিগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে ফের ধস

প্রকাশ | ০৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে অসমাপ্ত ফসল রক্ষা বাঁধ -যাযাদি
কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে সময় পার হলেও শেষ হয়নি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ। তাই চলতি বোরো মৌসুমে আবাদ নিয়ে শঙ্কায় সেখানকার কয়েক হাজার কৃষক। এদিকে, সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে দ্বিতীয়বারের মতো ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে ধস দেখা দিয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন হাওড়পাড়ের কৃষকরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত- হাওড়াঞ্চল (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চলে এবার পিছিয়ে গেল পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফসল রক্ষা বাঁধ সংস্কার ও নির্মাণের কাজ। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া কারণ হিসেবে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, নির্বাচনে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) লোকজন ব্যস্ত থাকায় সময়মতো কাজ শুরু করতে পারেননি। প্রতিটি বাঁধের জন্য একটি পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠনের নিয়ম রয়েছে। প্রতি বছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পিআইসি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর বাঁধ নির্মাণের সর্বশেষ সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২৮ ফেব্রম্নয়ারি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করতে না পারায় হাওড়াঞ্চলে রয়েছে আলোচনা সমালোচনা। অন্যদিকে কোনো কোনো জায়গায় বাঁধে মাটির পরিবর্তে বালুও দেখা গেছে। কোনো জায়গায় দেখা গেছে বাঁধের একদম কাছ থেকে মাটি তুলে আবার বাঁধের কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে এসব কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের দেখা মিলছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত সব প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের মাত্র ১২ দশমিক ৪২ ভাগ টাকা বরাদ্দ এসেছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে। জেলা পাউবো সূত্রে জানা গেছে, এবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জেলার ৯টি উপজেলা ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, নিকলী, তাড়াইল, করিমগঞ্জ, কটিয়াদী, বাজিতপুর ও ভৈরবে মোট ১২৪টি বাঁধের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যেগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ১৪১ দশমিক ৯৭৮ কিলোমিটার। পিআইসির মাধ্যমেই এসব কাজ করানো হচ্ছে। হাওড়ের বেশ কয়েকটি বাঁধের পিআইসি লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- অষ্টগ্রাম, ইটনা মিঠামইন উপজেলার ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণের কাজ এখনো অনেকখানি বাকি রয়েছে। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের পর কাজ শুরু করা হয়েছে। এবার যখন পিআইসি গঠনের সময় এসেছে, তখনই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার সময় ছিল বলেও তারা জানান। আর সে কারণেই পিআইসি গঠন যেমন পিছিয়ে গেছে, বাঁধের কাজের সূচনাও পিছিয়ে গেছে। এছাড়াও বাঁধের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর দুই পাশে ঘাস লাগানোর কাজ থাকে যেন বৃষ্টিতে মাটি কেটে না যায়। এবার বাঁধের কাজ পিছিয়ে যাওয়ায় ঘাস লাগানোর কাজও পিছিয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টি হলে প্রায় সব বাঁধই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাওড়পাড়ের কৃষকরা। সরেজমিন ইটনার বড়িবাড়ি ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, বড়িবাড়ি পাকা রাস্তার মাথা থেকে বলদা খেয়াঘাট পর্যন্ত কুনিয়ার হাওড়ে ৫টি আলাদা প্রকল্প আছে। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ২৫৮ কিলোমিটার। বাঁধের অধিকাংশ জায়গায় শক্ত মাটি ফেললেও কোনো কোনো জায়গায় বালু ফেলা হয়েছে। এ বিষয়ে একাধিক ব্যক্তি জানান, বন্যার পানি চলে আসলে বালুর জায়গাগুলোই সবার আগে ভেঙে যায়। এছাড়া পাকা ধান কাটার পর গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি বা টমটম দিয়ে ফসল পরিবহণ করার সময় রাস্তার বালুর অংশগুলো পার করতে খুব সমস্যা হয়। তাদের দাবি ভবিষ্যতে পুরো বাঁধটি যেন শক্ত মাটি দিয়ে সংস্কার করা হয়। অন্যদিকে অষ্টগ্রাম উপজেলা বেশ কয়েকটি বাঁধ ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধ নির্মাণের জন্য যে মাটি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো বাঁধের কাছ থেকেই তোলা হচ্ছে। এর ফলে বৃষ্টি হলেও মাটিগুলো ধসে বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিশোরগঞ্জের জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে পিআইসির লোকজন ব্যস্ত থাকা ছিল। তাই কাজগুলো শুরু হয়েছে দেরিতে। সে কারণে ২৮ ফেব্রম্নয়ারি কাজ শেষ করা যায়নি। তবে মাটির কাজ অধিকাংশ শেষ। তিনি আশাবাদী ৪-৫ দিনের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হয়ে যাবে। বাঁধে বালু ফেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপরে দুই-এক লেয়ার বালু পড়তে পারে, তবে সেগুলো পরিবর্তন করতে বলা হয়েছে। বাঁধ ঘেঁষে মাটি উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, এ কাজে অধিগ্রহণ থাকে না। তারপরও বাঁধ ঘেঁষে মাটি উত্তোলন উচিত না। তিনি দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাকে বিষয়টি সংশোধন করতে বলেছেন বলেও জানান। ধর্মপাশা ও মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, গত ২৮ ফেব্রম্নয়ারি কাজের সময় পেরিয়ে গেলেও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলার ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। ২৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত দুই উপজেলায় ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এবারও সময় মতো বাঁধের কাজ শেষ না হওয়া নিয়ে শঙ্কায় কৃষকরা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছে শিগগিরই বাকি কাজ শেষ হবে।  পাউবোর অধীনে দুই উপজেলার সোনামোড়ল, রুই বিল, কাইল্যানি, চন্দ্রসোনার থাল, ধানকুনিয়া, জয়ধনা, গোড়াডোবা, গুরমা ও গুরমার বর্ধিতাংশ হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ হচ্ছে। ধর্মপাশায় ৯৬টি ও মধ্যনগরে ৩২টি প্রকল্প রয়েছে। ধর্মপাশায় ৯৬টি প্রকল্পের বিপরীতে ২০ কোটি ৭০ লাখ ও মধ্যনগরে ৩২টি প্রকল্পের বিপরীতে ৬ কোটি ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত বুধবার পর্যন্ত ৯০ ভাগ কাজ হয়েছে। ধর্মপাশায় চন্দ্রসোনার থাল হাওড়ের ৫২ নম্বর প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান। মধ্যনগরের শালদিঘা হাওরের ৩১ নম্বর প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো করা হয়নি। এলোপাথাড়িভাবে মাটি ফেলে রাখা হয়েছে।  ৩১ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি সেলোয়ার হোসেন বলেন, বাঁধে মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়েছে। বাঁধের উপর দিয়ে গরু ছাগল চলায়  বাঁধ নষ্ট হচ্ছে।  হাওড় বাঁচাও আন্দোলনের মধ্যনগর শাখার সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন বলেন, 'সারা বছর আমরা একটি ফসলের উপর নির্ভরশীল। বাঁধের কাজে দায়িত্বশীল হতে হবে।' ধর্মপাশা উপজেলার দায়িত্বে থাকা সুনামগঞ্জ পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হবে। শান্তিগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওড়ের ছাইয়া কিত্তা ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ আবারও ধসে পড়ছে। কাজ শেষ হওয়ার আগেই এ নিয়ে দ্বিতীয়বার বাঁধে ধসের সৃষ্টি হয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন হাওড়পাড়ের কৃষক। পিআইসি কমিটির লোকজন ধস ঠেকাতে কাজ করছেন দিন-রাত। এর আগে প্রকল্প বাস্তবায় কমিটির লোকজন ৩শ' জিও বেগে মাটি ভরাট করে ধসে পড়া অংশ মেরামত করেছিলেন। ৭দিন যেতে না যেতেই আবার সেই অংশে বাঁধটিতে ধস দেখা দিয়েছে। সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, উপজেলার দেখার হাওড়ের ছাইয়া কিত্তার বাঁধ ৬নং পিআইসি কমিটির অধীনে। দেখার হাওড়ের ফসল রক্ষা বাঁধের পিআইসি নং-৬ এর অধীনে প্রায় ১০০০ মিটার বাঁধের কাজ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকার উত্তর পার্শ্বে 'ছাইয়া কিত্তা' নামক জায়গায় গত দুই বছর আগে বর্ষা মৌসুমে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রাতের আধারে মহাসিং নদী ও বাঁধের পশ্চিমে বালি মাটি ও ভিট বালি উত্তোলন করে। এতে বাঁধের দুই পাশে মহাসিং নদীর অংশে ও হাওড়ের অংশে বড় বড় দুইটি ডোবার সৃষ্টি হওয়ায় প্রায় ২৭ ফুট গভীর গর্ত হয়েছে। এর পর থেকে এই বাঁধে প্রতি বছর এই জায়গায় ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে। গত শনিবার রাতে আবারও সেই অংশে ফাটল দেখা দিয়ে বাঁধটি আবারও ধসে পড়তে শুরু করে। বর্তমানে ছাইয়া কিত্তা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ শেষ করে ঘাস লাগানোর কাজ চলছে। কিন্তু বাঁধের দুই পাশে আবারও ভাঙন শুরু হওয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে ফসল রক্ষা বাঁধ এবং আর্থিক সংকটে পড়ছেন পিআইসি কমিটির লোকজন। আস্তমা গ্রামের কৃষক ও পিআইসি কমিটির সভাপতি আজিমুল হক জানান, 'আমার প্রকল্পে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ফাটল দেখা দিয়ে বাঁধের মাটি ধসে পড়েছে। বাঁধের কাজ করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন ভাঙন রোধে আরও অর্থ বরাদ্দ দিয়ে দুটি গর্ত মাটি ভরাট করা প্রয়োজন। না হলে বাঁধ রক্ষা করা যাবে না। বৈশাখ মাসে হাওরে পানি এলে এ বাঁধ হুমকির মুখে পড়বে।' শান্তিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা কাবিটা কমিটির সদস্য সচিব ইয়াছিন খান বলেন, 'এখানের এই অংশের দুই পাশে গভীর দুটি গর্ত থাকায় এমনটি হচ্ছে। পশ্চিম পাশের গর্তটি এখান অনেকটাই ভরাট। ভাঙনও বন্ধ হয়েছে। এখন নদীর পাশের গর্তটিই বাঁধের জন্য হুমকি হিসেবেই আমরা দেখছি। এই জায়গায় আরও জিও বেগ দিয়ে ডাম্পিং করে তারপার বাঁধের স্স্নোপের কাজ করতে হবে। আশা করি ২-৩ দিনের মধ্যেই এই কাজটি শেষ করতে পারব।'