টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার তাঁতের শাড়ির ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেক পুরনো। সেই ঐতিহ্য ও সুনাম ধরে রাখতেই এ উপজেলার তাঁতশিল্পীরা যুগ যুগ ধরে মনের মাধুরী মিশিয়ে হাতের নিপুণ কারুকার্যের মাধ্যমে তৈরি করে আসছেন তাঁতের শাড়ি। এসব তাঁতের শাড়িই কালক্রমে টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ইতোমধ্যে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ছাড়া আগামীতে আন্তর্জাতিকভাবে জিআই স্বীকৃতি পেতে পারে এ শাড়িটি। অথচ বর্তমানে তাঁতশ্রমিক সংকট, শাড়ি তৈরির প্রধান কাঁচামাল সুতার উচ্চমূল্য, তুলনামূলক শাড়ির দাম কম হওয়ায় টাঙ্গাইলের শাড়ির উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁতমালিক, তাঁতশিল্পী ও শাড়ি ব্যসায়ীরা। তারা টাঙ্গাইলের শাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি সহযোগিতা কামনা করছেন।
জানা গেছে, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল এলাকায় সবচেয়ে বেশি টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয়। সে কারণে পাথরাইলকে টাঙ্গাইল শাড়ির প্রাণকেন্দ্র বা টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে বসবাসকারী বসাক পরিবারের মাধ্যমেই টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদনের সূচনা হয়। পরে দিন জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়।
বর্তমানে শাড়ির তৈরির ন্যায্য মজুরি না পেয়ে অনেক শ্রমিক পেশা বদল করছেন। ফলে দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট। অন্যদিকে শাড়ির উৎপাদন খরচ বেশি হলেও দাম কম। নানা সমস্যার মধ্য দিয়েও টাঙ্গাইলের শাড়ির সুনাম রক্ষায় কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা।
অতীতে হ্যান্ডলোমের (হস্ত ও পায়ের সাহায্যে চালিত তাঁত) মাধ্যমে শাড়ি তৈরির মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইলের শাড়ি সুনাম অর্জন করে। বর্তমানে শাড়ি তৈরিতে পাওয়ারলোম (যন্ত্রচালিত তাঁত) ব্যবহার করে টাঙ্গাইল শাড়ির এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। তাঁত মালিক, তাঁতশিল্পী ও শাড়ি ব্যবসায়ীরা দাবি করেন হ্যান্ডলোমে (হস্তচালিত তাঁত) তৈরি টাঙ্গাইল শাড়ির আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা বলেন হ্যান্ডলোমের শাড়ি আকর্ষণীয়, টেকসই ও পড়ে আরামদায়ক। অন্যদিকে পাওয়ারলোম যন্ত্রচালিত হওয়ায় হ্যান্ডলোমের মতো এত দরদ দিয়ে শাড়ি তৈরি করা যায় না। অথচ হ্যান্ডলোম ও পাওয়ারলোমে তৈরি শাড়ির পার্থক্য যারা বোঝে না তারাই পাওয়ারলোমের তৈরি শাড়ি কম দামে কিনে প্রতারিত হয়। এ অঞ্চলের তাঁতশিল্পীরা তাঁতের শাড়ির সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। পুরুষদের পাশাপাশি পরিবারের নারী সদস্যরাও ছিটায় সুতা তুলে দিয়ে শাড়ি তৈরির কাজে সহযোগিতা করেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার পাথরাইল এলাকায় টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদনের জন্য গড়ে উঠেছে তাঁতপলস্নী। আর তাঁতপলস্নী ঘিরে রয়েছে অসংখ্য টাঙ্গাইল শাড়ি শোরুম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে শাড়ি তৈরির ধুম। এ সময় খটখট শব্দে মুখরিত থাকে চারপাশ। উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নের পাথরাইল, চন্ডি, দেওজান, নলশোঁধা, আকন্দপাড়া, সদর ইউনিয়নের নলুয়াসহ কয়েকটি গ্রামে টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির কাজ করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয় পাথরাইল ও চন্ডি গ্রামে। বাংলাদেশ তাত বোর্ডের টাঙ্গাইল বেসিক সেন্টার সূত্রে জানা যায়, দেলদুয়ার উপজেলায় মোট হ্যান্ডলোম বা হস্তচালিত তাঁতকলের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৬০টি। এ ছাড়া মোট পাওয়ারলোম বা যন্ত্রচালিত তাঁতকলের সংখ্যা ১০০টি।
তাঁতশিল্পী কাশেম আলী, আনোয়ার হোসেন ও মাইন উদ্দিন জানান, শাড়ি তৈরি কাজে মজুরি কম থাকায় অনেকে পেশা বদল করেছেন। তারা অন্য কোনো কাজ করতে না পেরে দীর্ঘদিনের শাড়ি তৈরি কাজেই রয়েছেন। তাঁত মালিক গোবিন্দ বসাক জানান, আধুনিক যুগে অনেক নারীই থ্রিপিস ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া পাওয়ারলোমের শাড়ির কারণেও হ্যান্ডলোমের শাড়ির চাহিদা কমেছে। সে কারণে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরিতে তেমন লাভ নেই। তবে বাব-দাদার আমল থেকে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি কাজে জড়িত থাকায় কষ্ট হলেও শাড়ি উৎপাদনের কাজ করছেন।
টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক জানান, টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস অনেক পুরনো। আর হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমেই টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে অনেকেই হস্তচালিত বা হ্যান্ডলোম ও যন্ত্রচালিত বা পাওয়ারলোমের তৈরি শাড়ির পার্থক্য বোঝেন না। হ্যান্ডলোমের শাড়ি অবশ্যই ভালো মানের। অথচ অনেকেই কম দামে পেয়ে পাওয়ারলোমের শাড়ি কিনে প্রতারিত হন। হ্যন্ডলোমের শাড়িই টাঙ্গাইল শাড়ির সুনাম বয়ে এনেছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার জিআই স্বীকৃতি দিয়েছে। ভৌগোলিকভাবেই টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই স্বীকৃতির দাবি রাখে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের টাঙ্গাইল বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, টাঙ্গাইল শাড়ির সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে ও তাঁতশিল্পের মান উন্নয়নে তাঁতশিল্পীদের প্রশিক্ষণ এবং প্রান্তিক তাঁত মালিকদের জন্য সরকারিভাবে ক্ষুদ্রঋণ চালু রয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইলে মার্কেট প্রমোশন সেন্টার স্থাপন করার কাজ চলছে। এতে বিশেষ করে টাঙ্গাইল শাড়ি সঠিক মূল্যে বিক্রির সুব্যবস্থা থাকবে।