নদীভাঙন ও খাদ্য উৎপাদন কমার আশঙ্কা
থামছে না মাটি খেকোদের দৌরাত্ম্য
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না নদীর পাড় ও ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার মহোৎসব। শক্তিশালী মাটিখেঁকো চক্র শর্ত লঙ্ঘন করে নদী থেকে বালু তুলছে ও ফসলি জমির মাটি কাটছে। এসব মাটি বিক্রি করছে বিভিন্ন ইটভাটায়। এর ফলে একদিকে কমছে ফসলি জমির পরিমাণ, অন্যদিকে নদীভাঙনে ঘর হারানোর আশঙ্কা করছেন সাধারণ মানুষ। প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও কারাদন্ড দিলেও থামছে না মাটিখেঁকোদের দৌরাত্ম্য। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
হরিরামপুর (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর লেছড়াগঞ্জ বালুমহালের নির্ধারিত সীমানার বাইরে কয়েক কিলোমিটার দূরে থেকে বালু তোলা হচ্ছে। নির্ধারিত সীমানার বাইরে থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ হলেও ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাতটি ড্রেজার দিয়ে বালু তুলছেন ঠিকাদার। অবৈধভাবে এমন বালু উত্তোলনের ফলে নদীভাঙনের আশঙ্কা করছেন গোপীনাথপুর ও কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের নদীপাড়ের মানুষ। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে এমন চললেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
সরেজমিন দেখা যায়, এমবি মা-বাবার দোয়া ড্রেজিং প্রকল্প-৩, নূরে মদিনা ড্রেজিং প্রকল্প, এমভি হাফিজা ড্রেজিং, তিন্নি লোড ড্রেজিংসহ সাতটি ড্রেজার দিয়ে চলছে বালু উত্তোলন। উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ও উজানপাড়া এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের জিও ব্যাগে বালু সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া, বাল্কহেডের মাধ্যমে ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছে উত্তোলনকৃত বালু।
জানা যায়, হরিরামপুরে এ বছরই প্রথম বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ৬ এপ্রিল ১৪৩০ বাংলা সালের জন্য হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জসহ সাতটি বালুমহাল ইজারার বিজ্ঞপ্তি দেয় জেলা প্রশাসন। এতে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে লেছড়াগঞ্জ বালুমহালের ইজারা পায় মেসার্স দেওয়ান করপোরেশন। লেছড়াগঞ্জ মৌজার দিয়ারা জরিপ এক নম্বর খতিয়ানের ৩০০১ দাগের ৩২.৪৭ একর জমি ইজারাভুক্ত।
গোপীনাথপুর ও কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের নদীপাড়ের কয়েকজন জানান, যে জায়গা থেকে এখন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, সেটি কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের গৌরীবরদিয়া মৌজা এলাকায় পড়েছে। প্রায় দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে এখান থেকে বালু তোলা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছরই এই এলাকার মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়। এভাবে বালু তোলা হলে কিছুদিন পরে নদীভাঙন দেখা দিতে পারে।
তবে, গোপীনাথপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জানু বলেন, যে জায়গা থেকে বালু তোলা হচ্ছে, তা গোপীনাথপুর ইউনিয়নের কদমতলা এলাকায় পড়েছে। ওই এলাকাটি অনেক আগে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে কাঞ্চনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গাজী বনি ইসলাম রূপক বলেন, গোপীনাথপুর ও আমার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের সীমানা এলাকায় এক কিলোমিটার বাঁধের কাজ চলছে। বালু কোথা থেকে তোলা হচ্ছে, তা জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখছি।
সরেজমিন ড্রেজারে গেলে ড্রেজারগুলো বালুমহালের ড্রেজার বলে জানান শ্রমিকরা। শুভ নামের এক শ্রমিক বলেন, এগুলো বালুমহালের ড্রেজার।
গোপীনাথপুর ও কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের এক কিলেমিটার বাঁধের কাজের জন্য নদী থেকে বাল্কহেডে করে এনে আনলোড ড্রেজার দিয়ে পাড়ে বালু স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। সেখানে কথা হয় কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ইনচার্জ মো. জসিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক কিলোমিটার কাজের জন্য প্রায় ২৫ লাখ ঘনফুট বালু প্রয়োজন। প্রতি ঘনফুট বালু আমরা দুই টাকা ৩০ পয়সা করে বালুমহাল থেকে কিনছি।
ইজারাদারের পক্ষে পাউবোর কাজে বালু সরবরাহের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা উজ্জ্বল দেওয়ান বলেন, বালুমহালের নির্ধারিত জায়গায় চর জেগেছে। তাই বাইরে থেকে বালু তোলা হচ্ছে।
বালুমহালের ইজারাদার আলমগীর হোসেন বলেন, 'ওখানে নিয়ন্ত্রণ অন্যজন করে। আমার একটু জানতে হবে। আপনি বললেন, বিষয়টি আমি দেখব।'
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাঈন উদ্দিন বলেন, বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানাবেন। আগামী বছরের জন্য বালুমহাল ইজারা দিতে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভের জন্য ডিসি অফিস থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি এবার বালুমহাল ইজারা না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করবেন।
হরিরামপুর সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাপসী রাবেয়া বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হিজলা (বরিশাল) প্রতিনিধি জানান, বরিশালের হিজলা উপজেলার শেষ প্রান্ত জানপুরসহ কয়েকটি চরাঞ্চলে রয়েছে হাজার একর ফসলি জমি। এই চরাঞ্চলের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে অবৈধভাবে ইটভাটার জন্য একদল মাটিখেঁকোরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষক, ধ্বংস হচ্ছে ফসলি জমি।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে এই চক্রটি। সেখানে প্রায় ১৫-২০টি ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে ২ শতাধিক ট্রলিতে মাটি বহন করে নদীর কিনারায় টার্মিনালের মাধ্যমে বালগেডে করে দেশের বিভিন্ন জেলায় ইটভাটায় এই মাটি পাচার করছে।
মাটি কাটা সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা জেলা যুবলীগ নেতা মুন্নার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি শুধু পরিচালনার দায়িত্বে আছি। এর বেশি কিছু জানি না।'
হাইমচর ইউএনও পূর্বিতা চাকমা জানান, মাটি কাটার বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছেন। সরেজমিন গেলে জানা যাবে, জমি হিজলার না হাইমচরের। তবে ফসলি জমি কাটার অধিকার কারও নেই। হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদীপ্ত সিংহ বলেন, সরেজমিন গিয়ে মাটি কাটার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাজিতপুর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও নিকলীর বিভিন্ন হাওড়ে ভেকু দিয়ে কৃষি জমি থেকে মাটি কাটা থামছে না। উপজেলার সদর ইউনিয়ন, জারইতলা, গুরুইসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে অসাধু মাটিখেঁকোরা বর্তমান রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে জমির উর্বরা শক্তি কমিয়ে দিচ্ছে। পাশের কৃষি জমির মালিকরা কিছু বললে তাদের কথা মানছে না। এদিকে উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটখোলায় কিয়দংশ মাটি চলে যাচ্ছে। এর ফলে পাশের জমি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসবের ফলে গ্রামীণ অবকাঠামো রাস্তাঘাট ভেঙে যাচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তার মধ্যে বালি উড়ে শিশু ও বৃদ্ধসহ মানুষ কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
বাজিতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হোসাইন বলেন, প্রতিদিন এসব ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হচ্ছে। তাদের ফের জরিমানা করবেন।
পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার মাশালডাঙ্গী ব্রিজ এলাকাসহ টাঙ্গন নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করছেন অসাধু বালু খেকোরা। তারা অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করার পাশাপাশি নদীর পাড়েই বিশাল বিশাল বালুর স্তূপ গড়ে তুলেছেন। বর্ষা মৌসুমে এসব বালু চড়া দামে বিক্রি করবেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেও থামানো যাচ্ছে না। এদিকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উপজেলার মাশাল ডাঙ্গী ব্রিজের অদূরে উত্তর পাশে মাঞ্চালা এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গন নদীতে ট্রাক্টর নামিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদী থেকে কয়েক হাজার ট্রলি বালু উত্তোলন করে নদীর পাড়ের উঁচু জায়গায় বিশাল বিশাল কয়েকটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ওই এলাকার বেশ কয়েকজনের একটি চক্র বালু উত্তোলন করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করার পাশাপাশি বালু মজুদ করেছেন। বর্তমানে নদীতে পানি কম থাকায় নদী থেকে বালু উত্তোলন করে প্রতি ট্রলি বালু দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। মজুদ করা বালু বর্ষা মৌসুমে আরও চড়া দামে বিক্রি করা হবে বলে স্থানীয়রা জানান।
এ ছাড়া টাঙন নদীর সাগুনী, বাজারদেহা, কোষারণীগঞ্জ, নাকাটি, কাস্তোর, গেঞ্চিডোবা, জাবরহাট, আজলাবাদ ও বৈরচুনাসহ বেশ কয়েকটি ঘাট থেকে প্রতিদিন শত শত গাড়ি বালু উত্তোলন করে বিক্রি করার পাশাপাশি মজুদও করছেন বালু খেকোরা। এতে একদিকে সরকার লাখ লাখ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছেন, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়ছেন নদী পাড়ের মানুষ।
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুলস্নাহ আল রিফাত জানান, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ঠেকাতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক দিনে টাঙ্গন নদীর বিভিন্ন ঘাট থেকে বেশ কয়েকটি ট্রলি আটক করে জরিমানা করা হয়েছে। দুটি ট্রলি এখনো উপজেলা পরিষদে আটক আছে। অবৈধভাবে মজুদ করা বালু প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।