মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের শিশুরা মাতৃভাষার বই পেলেও আসেনি সফলতা

পাহাড়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানে নেই সাফল্য

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

ক্যমুই অং মারমা, বান্দরবান
প্রতিবছর নতুন বছর আসলে উৎসবমুখর পরিবেশে বিতরণ করা হয়। জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে জাতীয় পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তিন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের শিশুরাও পেয়েছে নিজ মাতৃভাষার বই। এতে উচ্ছ্বাসও বহুগুণ বেড়ে যায় তাদের মধ্যে। তবে অভিভাবক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও ভাষা গবেষকরা বলছেন, দীর্ঘ আট বছর ধরে মাতৃভাষার বই পেলেও তেমন সাফল্য আসেনি। এ জন্য দক্ষ শিক্ষকের অভাবকে দায়ী করছেন তারা। শিক্ষা কর্মকর্তারাও বলছেন, শিগগিরই মাতৃভাষায় পাঠদানের ওপর কর্মরত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। অন্যথায় সাফল্য আসবে না ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমে, সংরক্ষণ করা যাবে না বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বর্ণমালা। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাস করে মারমা, চাকমা, বম, ত্রিপুরা, খুমি, লুসাই ও খিয়াংসহ ১১ জনগোষ্ঠী। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি যাতে বিলুপ্ত না হয় সে লক্ষ্যে বাংলা ভাষার পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ২০১৭ সালে পার্বত্য এলাকার জন্য সরকার মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের। যা ধারাবাহিকভাবে চলছে। শিশুদের আনন্দের সঙ্গে পাঠদানের জন্য স্ব স্ব নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপাদান নিয়ে ছড়া, কবিতা, গল্প সংযোজন করা হয়েছে উপকরণগুলোতে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, বান্দরবানে এ বছর তিন সম্প্রদায়ের ৯ হাজার শিক্ষার্থীকে ২০ হাজার ৪২০টি মাতৃভাষার বই বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে পাহাড়ে প্রতিবছর নিজ মাতৃভাষার বই তুলে দিলেও চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুদের নিজ ভাষায় পাঠদানে সাফল্য আসেনি। এ জন্য বিশিষ্টজনরা দায়ী করছেন, নিজ নিজ মাতৃভাষায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবকে। তারা বলছেন, মাতৃভাষায় পড়ানোর জন্য কর্মরত শিক্ষকদেরও দক্ষ করে তোলা হচ্ছে না, আবার মাতৃভাষার শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু কেবল বই বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। ফলে শুধু বই শিশুদের পঠন ও লিখনের ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসছে না। পরীক্ষার ফলাফলে মাতৃভাষার শিক্ষার মূল্যায়ন নেই, তবুও নিজ মাতৃভাষার বই পড়তে চায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা। উজানীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী এনুচিং মার্মা জানায়, 'প্রতিবছর মাতৃভাষার বই পাই আমরা। তবে লিখতে বা পড়তে জানি না। এবারও পেয়েছি। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এ বই পড়ান না।' একই বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী শৈ শৈ মার্মা জানায়, প্রতি বছরই পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে তারা মাতৃভাষায় নতুন বই পেয়ে থাকে। তারা পড়তে চায়, কিন্তু পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই। তাই বইগুলো বাড়িতেই রেখে আসে। উজানীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ডনুপ্রু মার্মা জানান, 'আমরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারি, কিন্তু মাতৃভাষার বর্ণমালাগুলো পড়তে এবং লিখতে পারি না। তাহলে আমরা শিশুদের কিভাবে পড়াব।' তার মতে, শিক্ষকদের মাতৃভাষা শিক্ষার উপর কমপক্ষে দেড় বছরের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারা দক্ষ হবেন এবং শিশুদের পড়াতে পারবেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং পাঠদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ একই ক্লাসে বহুভাষায় কথা বলা শিক্ষার্থীদের পাঠদান পদ্ধতি প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির চেয়ে আলাদা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংকটের কারণে সরকারের এ উদ্যোগের সুফল বঞ্চিত পাহাড়ি শিশুরা। শিক্ষক, লেখক ও মারমা ভাষার গবেষক ক্যশৈ প্রম্ন খোকা বলেন, প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু কেবল বই বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কারণ শিক্ষকদের মাতৃভাষায় পড়ানোর জন্য যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে মাতৃভাষার বইয়ের উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো কোন সাফল্য আসবে না ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীদের মাতৃভাষার শিক্ষায়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, এবার জেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়েই বাংলা ভাষার পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তিনটি নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষার বই দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সহায়তায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাতৃভাষায় পাঠদানে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার আশা, এর মাধ্যমে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান আরও সুন্দর, শানিত ও সমৃদ্ধ হবে।