শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর

এখনো অধরা ভাষাসৈনিক চুন্নু মিয়ার স্বীকৃতি

মোবাশ্বির হাসান শিপন, বোরহানউদ্দিন (ভোলা)
  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ভোলার বোরহানউদ্দিনে ভাষাসৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার বাড়ি -যাযাদি

ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পরও বিভিন্ন মহলের দাবি সত্ত্বেও ভোলার একমাত্র ভাষাসৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার স্বীকৃতি ও তার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কয়েকবার আশ্বাসের পরও ওই দাবি বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। এখনো ভোলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তার স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি তুলছেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ১০ বছর আগে ভাষাসৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছিলেন ভোলার সচেতন মহল। ভোলা জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক বেলায়েত হোসেন বরাবর স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি দেন এলাকাবাসী। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস পাওয়া গেলেও এখনো তা অধরা রয়ে গেছে।

এ ভাষা সৈনিকের পুরো নাম রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু হলেও 'চুন্নু স্যার' নামে সর্বমহলে পরিচিত। তার ব্যক্তিগত ডায়েরি, ভোলা জেলার ইতিহাস, বোরহানউদ্দিন থানার ইতিহাস ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করার সময় মাত্র ২১ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

তার ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রম্নয়ারি পূর্ব পাকিস্তান সরকার অপরাহ্নে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা পূর্বেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চুন্নু মিয়ার ভাষায়, 'আমরা জানতাম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে গেলে নিশ্চিত গুলি হবে। তারপরও মায়ের ভাষার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আমাকে মিছিলে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। হঠাৎ মনে পড়ে আমি যদি আগামঅকাল মিছিলে গিয়ে গুলিতে শহীদ হই, তাহলে আমার লাশের সন্ধান হয়তো আত্মীয়রা পাবে না। একথা ভেবে আমি রাতে বসেই আমার পুরো নাম ঠিকানা সাদা কাগজে লিখে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। যাতে এই ঠিকানা অনুযায়ী আমার লাশ অন্তত স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।'

বায়ান্ন'র ২১ ফেব্রম্নয়ারি ভোর থেকেই ছাত্র নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী ৮-১০ জনের খন্ড মিছিল শুরু হয়। কলেজের তৃতীয় ব্যাচের মিছিলে ছিলেন তিনি। মিছিল যখন কলাভবনের কাছে পৌঁছল তখন তাকেসহ অনেককে আটক করে পুলিশ। পরদিন কোর্টে হাজির না করেই এক ঘণ্টার মধ্যে তাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। এক মাস কারাভোগের পর ২১ মার্চ মুক্ত আকাশের বেরিয়ে আসেন।

১৯৭১ সালে চুন্নু মিয়া ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তিনি নিজেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি। একাধারে ৪টি স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি শুধু গ্র্যাজুয়েট হয়েও আব্দুল জব্বার কলেজে শিক্ষকতা করেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের উপর তার লেখা বই "অনন্য সাধন" সবার প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু "খেকশিয়ালের অধঃপতন" পান্ডুলিপি জীবদ্দশায় প্রকাশ করে যেতে পারেননি।

স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে চুন্নু মিয়ার বড় ছেলে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কবির চৌধুরী ও ছোট ছেলে সাহিত্যিক মাহাবুব-উল-আলম চৌধুরী বলেন, 'বাবার মুখে আমরা ভাষা আন্দোলনের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা শুনেছি। ওই সময় তিনি স্বীকৃতি, স্মৃতি সংরক্ষণ হবে বা হবে না এ চিন্তা করে আন্দোলনে যোগ দেননি। মায়ের ভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। এখন রাষ্ট্র চাইলে ১৯৫২ সালের জেল রেকর্ড তলব করলেই ঘটনার সত্যতা বের হয়ে আসবে। তারা মনে করেন, রাষ্ট্র উদ্যোগী হয়ে ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা উচিত।

বোরহানউদ্দিন পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম বলেন, 'অচিরেই ভাষাসৈনিক চুন্নু স্যারের নামে নবনির্মিত একটি সুপরিসর সড়কের নামকরণ করা হচ্ছে।'

ভোলা-২ (বোরহানউদ্দিন-দৌলতখান) আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল জানান, 'চুন্নু স্যার আমার প্রিয় শিক্ষক। স্যারের নামে বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রবেশ দ্বারে একটি সুদৃশ্য তোড়ন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভোলা-চরফ্যাশন সড়ক প্রশস্থকরণ পরিকল্পনার পর ওই উদ্যোগ স্থগিত করা হয়। সড়ক প্রশস্থকরণের পরপরই বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রবেশ দ্বারে তোড়ন নির্মাণ হবে।'

উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের আব্দুল জব্বার মিয়া বাড়িতে ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভাষাসৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এ ব্যক্তি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ২০০৭ সালের ২ মার্চ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে