ভার্মি কম্পোস্ট সারে শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান

মহামারি করোনায় পাল্টানো জীবন

প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

গোলাম মোস্তফা, মেহেরপুর প্রতিনিধি
মেহেরপুরের তরুণ উদ্যোক্তা রিমন শেখের ভার্মি কম্পোস্ট সারের প্রজেক্ট -যাযাদি
মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা রিমন শেখ কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে অনার্স করছিলেন। শিক্ষার্থী থাকাকালীন সময়ে সেখানে টিউশনি করে থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন নিজেই। কোনো মাসে খরচ কম হলে টিউশনির টাকা মাঝে মাঝে কিছু জমাও হতো। তবে হঠাৎ ওই বছরে মহামারি করোনা রিমন শেখের জীবন ওলোট পালট করে দেয়। টিউশনি বন্ধ হয়ে যায়। উপায়ান্তর না পেয়ে নিজ বাড়ি আমঝুপিতে চলে আসেন। টিউশনি না থাকায় রোজগারের নতুন পথ খুঁজতে থাকেন। করোনায় সব লকডাউন থাকায় বাড়িতে বসেই লেখাপড়া চালাতে থাকেন। এর মধ্যেই জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে টিউশনির জমানো মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকায় প্রথমে স্বল্পপরিসরে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির প্রজেক্ট হাতে নেন। তার সেই প্রজেক্ট ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এখন তার ফার্মটি ২৫ লাখ টাকার প্রজেক্টে রূপ লাভ করেছে। এই কেঁচো কম্পোস্ট সার থেকেই সব খরচ বাদে মাসে লাখ টাকা আয় হচ্ছে তার। এরই মধ্যে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছেন। এখন চাকরির পিছে না ঘুরে অন্যকে তার প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। জৈব সারে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসল উৎপাদনের প্রয়োজনীয় ১৬টি উপাদান বিদ্যমান আছে। উদ্যোক্তা ও কৃষকরা জানান, রাসায়নিক সার একবার ব্যবহার করে পরের বার তার দিগুণ সার প্রয়োগ না করলে ফসল ভালো হয় না। জৈব সার একবার ব্যবহার করলে তার সুফল অন্তত দুই বার পাওয়া যায়। জৈব সারে জমির স্বাস্থ্য ও প্রাণ সতেজ থাকে। রাসায়নিক সার ব্যবহারে তাৎক্ষণিক সুফল পাওয়া যায়। জৈবসারে দীর্ঘস্থায়ীভাবে মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষকরা এখন জৈব সারের দিকে ঝুঁকছেন। তাই রিমনের তৈরি ভার্মি কম্পোস্ট সার তার বাড়িতে থেকেই কৃষকরা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আর রিমন মহামারি করোনায় টিউশনি চলে যাওয়ায় হতাশ না হয়ে জীবন পাল্টে এখন মাসে লাখ টাকা আয় করছেন বাড়িতে বসে। রিমন যায়যায়দিনকে জানান, করোনায় কুষ্টিয়াতে টিউশনি হারিয়ে হতাশ না হয়ে আয় রোজগারের পথ খুঁজতে থাকেন। বাড়ির পাশেই বাবার এক বিঘার একটি আম বাগান আছে। ওই বাগানে টিউশুনির সাড়ে তিন হাজার টাকার কেঁচো কিনে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি শুরু করেন। ফার্মের নাম দেন 'সোনার বাংলা এগ্রো'। ছাত্র হওয়ায় খবর পেয়ে কৃষি বিভাগের লোকজন সার তৈরির নানা কৌশল ও পরামর্শ দেয়। সম্প্রতি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন তার সার ঢাকায় ল্যাব টেস্টে পাঠিয়েছিলেন। টেস্টে এই সারে সব উপাদান বিদ্যমান রয়েছে বলে জানায়। এখন সরকার তাকে সারগুলো মোড়কে প্যাকেজিং করে বিক্রি করার অনুমতি দিলে বাজারে এর চাহিদা আরও বাড়বে। তার মতো নতুন আরও উদ্যোক্তাও তৈরি হতো। তাহলে দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা কমে যেত। ভোক্তারাও কেমিক্যাল ও বিষাক্ত উপাদান প্রয়োগে উৎপাদিত ফসল থেকে মুক্তি পেত। কমে যেত কৃষকের ফসল উৎপাদন খরচ। রিমনের বাবা জমিরুল ইসলাম বলেন, তিনি এখন তার ছেলের প্রজেক্ট দেখাশুনা করেন। ছেলে তাকে আর বাইরে কাজ করতে দেয় না। এখানে এখন চারজন নিয়মিত শ্রমিক কাজ করে। তাদের কাজে তিনিও সহযোগিতা করেন। প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা শ্রমিক খরচ, ৫০ হাজার টাকার গোবর ক্রয় ও ১০ হাজার টাকার বস্তা ক্রয় করতে হয়। বর্তমানে প্রতিমাসে ২৪ টন ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি টন সার বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার টাকায়। এছাড়া কেঁচো বিক্রি হচ্ছে চার হাজার টাকা কেজি। সব খরচ বাদ দিলেও মাসে লাখ টাকা আয় হচ্ছে। ছেলের এখন টার্গেট গোবর ক্রয় না করে গরু কিনবে। টাকা জমাচ্ছে। গাভী ও ষাড় গরু কিনে আলাদা ফার্ম করা হবে। সরকারি সহায়তা পেলে দ্রম্নতই ফার্ম করা সম্ভব হবে। নতুন উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, রিমনের সফলতা দেখে ভার্মি কম্পোস্ট জৈবসার প্রস্তুত করার প্রজেক্ট গড়েছেন তিনিও। আশা করছেন আর ৩-৪ মাস পর থেকে সুফল পেতে শুরু করবেন। সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'মেহেরপুর কৃষিতে সমৃদ্ধ একটি জেলা। জমির স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য জৈব সারের কোনো বিকল্প নেই। এই সার ভার্মি কম্পোস্ট হলে জমির শক্তি ১০ গুণ বেড়ে যায়। রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাত্রা কমানো যায়। বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন ও বিক্রি করে ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন করেছেন শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা রিমন শেখ। তার এই সাফল্যে এলাকার নতুন নতুন তরুণ উদ্যোক্তা অর্থনৈতীকভাবে স্বাবলম্বী হতে অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। আমরা তাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।'