'মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই। ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই।' নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের এই মহান উক্তিটি কাজে লাগিয়ে মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত। মৌমাছির গুনগুন শব্দে মুখরিত হয় সরিষা, ধনিয়া ও কালোজিরার মাঠ। মৌমাছিরা এক ফুল থেকে আরেক ফুলে নাচানাচি করে। এ যেন সরিষা ও কালোজিরা ফুলের সঙ্গে তাদের গভীর মিতালি।
মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বিভিন্ন দিগন্ত ফসলের মাঠজুড়ে অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে। চারদিকে ধনিয়া ও কালোজিরা ফুলের হলুদের সমারোহ। যেদিকে চোখ যায় মনে হয় যেন হলুদ চাদরে ঢেকে আছে ফসলের মাঠ। শিবচরে মধুচাষিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সরিষা, ধনিয়া ও কালোজিরা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহে। ফসলের জমির পাশে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌয়ালরা। ওইসব বাক্স থেকে হাজারও মৌমাছি মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরিষা, ধনিয়া ও কালোজিরা ফুলের মাঠে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, উপজেলায় ২১ জন মৌচাষি ১ হাজার ৩১৬টি মৌবাক্সের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করছেন। সাধারণত অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে বেশি পরিমাণে মধু সংগ্রহ হয়। মৌবাক্সের মাধ্যমে মধু সংগ্রহে মৌচাষি ও শর্ষেচাষি উভয়ই লাভবান হয়ে থাকেন। মধু চাষের মাধ্যমে মৌচাষিরা যেমন বাড়তি আয় করেন, তেমন মৌমাছির পরাগায়ণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
মৌচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাষিরা সাধারণত পছন্দের একটি সরিষা ক্ষেতের পাশে খোলা জায়গায় চাক ভরা বাক্স ফেলে রাখেন। একেকটি বাক্সে মোম দিয়ে তৈরি ৮ থেকে ১০টি মৌচাকের ফ্রেম রাখা হয়। আর এর ভেতর রাখা হয় একটি রানি মৌমাছি। রানি মৌমাছির কারণে ওই বাক্সে মৌমাছিরা আসতে থাকে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু এনে বাক্সের ভেতরের চাকে জমা করে। আর এই চাক থেকেই মধু সংগ্রহ করেন চাষিরা। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মৌ-চাষিরা এসব মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন।
সাতক্ষীরা থেকে আসা সেলিম মিয়া জানান, উপজেলার দ্বিতীয়খন্ড ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ কালোজিরা ক্ষেতে ১৩৫টি মৌ বাক্স বসিয়েছেন। এসব বাক্স থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে প্রায় সাড়ে ৬ থেকে ৭ মণ মতো মধু পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি কেজি মধু ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি।
আরেক মৌচাষি কামরুজ্জামান বলেন, 'আমি প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর ধরে মধু সংগ্রহ করে আসছি। কাদিরপুর এলাকায় প্রায় ১৫ দিন ধরে মধু সংগ্রহ করছি। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ মণ মধু সংগ্রহ করতে পেরেছি। এ মধু ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করছি।'
কাদিরপুরে এলাকায় ময়মনসিংহ থেকে আসা মৌচাষি জিহাদ বলেন, ধনিয়া ও কালোজিরা ক্ষেতের পাশে মধু সংগ্রহের জন্য ১৫৬টি বাক্স বসানো হয়েছে। তবে আবহাওয়া কিছুটা খারাপ হওয়ার কারণে মধু কম সংগ্রহ হয়েছে।
মৌচাষিরা জানান সরিষা ফুলের মধু রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকাররাও ক্রয় করেন। চাহিদা অনুযায়ী মধু বিক্রি করেন তারা। চাহিদা বেশি হলে দাম কিছুটা বেশি পান। আবার তুলনামূলক চাহিদা কম হলে দামও কিছুটা কম পান। তারা প্রতিকেজি সরিষা ফুলের মধু ৬শ' থেকে ৭শ' টাকা দরে বর্তমানে বিক্রি করেন তবে স্থানীয়দের কাছে তারা ৫শ' টাকায় বিক্রি করে থাকেন বলেও জানান মৌচাষিরা।
ওই এলাকার বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, 'রাস্তার পাশে মধু সংগ্রহ করা দেখে বাইক থামিয়ে মধু কিনলাম। এখানে একদম প্রাকৃতিক খাঁটি মধু পাওয়া যায়। দামেও কিছুটা কম। তাই একবারে বেশি করে কিনে নিয়ে যাব।'
শিবচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির বিচরণ থাকায় ফুলের পরাগায়নে সহায়ক হয়। ফলে সরিষার ফলনও বেশি হয়। উপজেলায় চলতি মৌসুমে ৪ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের সরিষার আবাদ হয়েছে।
তিনি বলেন, বাক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকেন মৌয়ালরা। এ ব্যাপারে সরিষাচাষি ও মৌবাক্স স্থাপনকারীদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি অফিস নানাভাবে কৃষকদের পরামর্শ ও উৎসাহিত করছে।
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুলস্নাহ আল মামুন বলেন, মৌয়ালরা বাণিজ্যিকভাবে বাক্স পদ্ধতিতে সরিষা, কালোজিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। প্রতি বছর দেশের অন্য অঞ্চল থেকে অনেক মধুচাষি তাদের মৌমাছি কলোনি ব্যবহার করে মধু সংগ্রহ করতে উপজেলায় আসেন। আশা করি এই মৌসুমে মধু চাষিরা ভালো ফলন পাবে।'