সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সরিষা চাষে স্বপ্ন বুনছেন প্রান্তিক কৃষক

স্বদেশ ডেস্ক
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
চট্টগ্রামের পটিয়ার একটি সরিষা ক্ষেত -যাযাদি

চুয়াডাঙ্গা, শরীয়তপুরের ভেড়ামারা ও চট্টগ্রামের পটিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে সরিষার আবাদ। ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় অর্থনৈতিক সচ্ছলতার স্বপ্ন বুনছেন প্রান্তিক কৃষকরা। তাই আরও বেশি সংখ্যক কৃষককে প্রণোদনা সুবিধায় আনার দাবি তাদের। আঞ্চলিক স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-

স্টাফ রিপোর্টার, চুয়াডাঙ্গা জানিয়েছেন, প্রণোদনা সুবিধায় ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে চুয়াডাঙ্গা জেলার চারটি উপজেলায় গত পাঁচ অর্থবছরে বেড়েছে সরিষার আবাদ। আমন ধানকাটার পর বোরো ধান রোপণের আগে কৃষকরা তাদের জমিতে সরিষার আবাদ করছেন। তারা সরিষার ভালো ফলন পাবেন বলে আশা করছেন।

সরিষা আবাদে প্রণোদনা বাড়িয়ে আরও বেশি সংখ্যক কৃষককে এর আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সদর উপজেলায় ৩১০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ২ হাজার ৪৮৫, দামুড়হুদায় ৩১০ ও জীবননগর উপজেলায় ৪১০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এ আবাদে সদর উপজেলার ১ হাজার ১২০ জন কৃষক ৬ লাখ ২৬ হাজার ৬৪০ টাকা, আলমডাঙ্গা উপজেলার ৮ হাজার ৬৪০ জন কৃষক ৪৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮০ টাকা, দামুড়হুদা উপজেলার ১ হাজার ৪৩০ জন কৃষক ৭ লাখ ২৫ হাজার ১০ টাকা ও জীবননগর উপজেলার ১ হাজার ৪১০ জন কৃষক ৭ লাখ ১৪ হাজার ৮৭০ টাকার প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৩৩ মেট্রিক টন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবার কৃষকরা টরি-৭ এবং বারি-৯, ১৩ ও ১৪ জাতের সরিষা বেশি আবাদ করেছে। সরিষা ফসল উঠতে ৮৫ থেকে ৯০ দিন সময় লাগে।

সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল হক জানান, চুয়াডাঙ্গার মাটি সরিষা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। টরি-৭ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় ৩ থেকে সাড়ে তিন মণ, রাই-৫ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় সোয়া ৩ থেকে সাড়ে ৩ মণ, বারি জাতের ৭-৮ সরিষা প্রতি বিঘায় সাড়ে ৬ থেকে ৮ মণ, বারি-৯-১০ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় ৬ থেকে ৮ মণ, বারি-১১ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় সাড়ে ৬ থেকে ৮ মণ, বারি-১২ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় ৫ থেকে ৬ মণ, বারি-১৩ ও ১৪ জাতের সরিষা প্রতি বিঘায় ৭ থেকে ৯ মণ উৎপাদন হয়।

জেলার শৈলগাড়ী গ্রামের সরিষা চাষি তাজু বলেন, ১২ কাঠা জমি পড়েই থাকে। ওই জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। এবার দেড় মণের মতো সরিষা হবে। খরচ ২ হাজার হয়েছে। ৪ হাজার টাকা লাভ থাকবে।

সরিষা চাষি সাদিব জানান, ধান আবাদের আগে এ জমিটা পড়েই থাকত। ১০ কাঠা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। সরিষা ভালোই হয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে অনেক পড়ে থাকা জমিতে সরিষা চাষ সম্ভব।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা জানান, সরকারের প্রণোদনার ফলে জেলায় কয়েক বছর ধরে সরিষার আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে তেল আমদানি করতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। এ প্রক্রিয়ায় সরিষার আবাদ করলে তেলের উৎপাদন বাড়বে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গায় সরিষার আবাদ বাড়ানোর জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

পটিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের পটিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় নানা জাতের সরিষার ক্ষেত দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। উপজেলার বিস্তীর্ণ ১৩০ হেক্টর জমিতে যেন হলুদের রঙছটা। স্বল্প সময় আর কম খরচে সরিষা চাষে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার স্বপ্ন বুনছেন প্রান্তিক কৃষক।

গত বছরের তুলনায় এ বছর পটিয়ায় বেড়েছে সরিষার আবাদ। আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তারা। উপজেলা কৃষি অফিসের বিনামূল্যে সার বীজ, বিশেষ প্রদর্শনীর মাধ্যমে কৃষকরা সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এছাড়াও অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বেশির ভাগ জমিতেই বিনা-১১, বারি-১৪, ১৭, ১৮ জাতের সরিষার আবাদ করছেন কৃষকরা।

চলতি মৌসুমে উপজেলার কচুয়াই, কাশিয়াইশ, জিরি ভাটিখাইন, কেলিশহর, হাইদগাঁও, খরনা, ইউনিয়নসহ পৌর এলাকার পতিত জমিতে বিভিন্ন জাতের সরিষার ভালো ফলন হয়েছে।

প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা কৃষি অফিসের সহয়তা ও প্রণোদনায় নতুন চাষিরাও সরিষা চাষ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বিগত অর্থবছরে উপজেলায় মোট ৭২ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়। আর চলতি বছরে ১৩০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।

পটিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় কয়েক জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে বারী সরিষা- ১৪, ১৭, ১৮ জাতের সরিষার চাষ এখানে বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়াও বীনা ১১ জাতের সরিষাও চলতি অর্থবছরে ১৩০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে।

সরিষা চাষে আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখছেন উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের উত্তর শ্রীমাই এলাকার প্রান্তিক কৃষক আবদুল জব্বার। ব্যক্তি উদ্যোগে ও প্রণোদনার বীজ দিয়ে ৪৪০ শতক জমিতে বারি-১৪ জাতের সরিষার আবাদ করেছেন তিনি। কৃষি বিভাগ থেকে বীজ পাওয়ায় সন্তুষ্টও।

৪৪০ শতক জমিতে সরিষা চাষে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগ্রহী হলেও আর্থিক সংকটে অনেকেই সরিষা চাষ করতে পারছেন না। সরকারিভাবে প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হলে কৃষকরা সরিষা চাষ করে আর্থিক সচ্ছলতা পেতেন।

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দীপন চৌধুরী বলেন, সরিষা আবাদে তেমন সেচের প্রয়োজন হয় না। কম সময়ে সরিষা চাষে ফলন পাওয়া যায়। সরিষা উৎপাদন করে দেশের সরিষার তেলের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ কল্পনা রহমান বলেন, 'আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে খাদ্য স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি সরিষা আবাদ করে তেল উৎপাদনেও স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।

ভেড়ামারা (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি জানান, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ যেন ঢেকে গেছে সরিষা ফুলের হলুদ চাদরে। এ বছর অন্যবারের তুলনায় ১২৮ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেশি হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখছেন চাষিরা।

মূলত এটি একটা বাড়তি ফসল হিসেবে চাষ করে। বাজারে প্রতি মণ সরিষা ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত এখন বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় জাতের সরিষায় হেক্টর প্রতি ফলন হয় দশমিক ৫ থেকে ৬ টন। সে তুলনায় বিনা ও বারিসহ উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষায় ফলন হয় হেক্টর প্রতি দেড় থেকে দুই টন। এ জাতের সরিষা চাষে কৃষকদের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করায় এ বছরও এর চাষ বেশি হয়েছে। সেই সঙ্গে কৃষককে বিনামূল্যে ভালো জাতের বীজ দেওয়ায় এবার সরিষার চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কৃষক আবজাল হোসেন বলেন, এবার চার বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছেন। ফুল থেকে ফল আসতে শুরু করেছে। বাড়ির সারা বছরের খাবারের তেল রেখে বাকিটা বিক্রি করে দেবেন।

কৃষক বাবুল হোসেন বলেন, আমন ধান কাটার পর বোরো আবাদের আগ পর্যন্ত জমি ফেলে না রেখে এই সরিষা চাষ করেছেন। এতে বাজারের বাড়তি দামে ভোজ্যতেল কেনার প্রয়োজন পড়বে না। এখন পর্যন্ত জমিতে কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। এতে ভালো ফলন পেয়ে লাভবান হতে পারবেন।

ভেড়ামারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মাহমুদা সুলতানা বলেন, উপজেলায় এ বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৫৫৮ হেক্টর। তবে এবারে মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে গত বছরের চেয়ে এবার সরিষা চাষ ১২৮ হেক্টর জমিতে বেশি হয়েছে। সরকারি সহায়তা ও কৃষি অফিসের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির কারণে দিন দিন সরিষার চাষ বাড়ছে। আমরা চাষিদের সব সময় রোগবালাই প্রতিরোধে পরামর্শ দিচ্ছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে