কমছে বেকারত্ব বাড়ছে রাজস্ব
কাপ্তাই হ্রদে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ
প্রকাশ | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সাকিব আলম মামুন, লংগদু (রাঙামাটি)
ষাটের দশকে প্রমত্তা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যে সুবিশাল জলাশয় তৈরি হয়েছে, কালের পরিক্রমায় সেটিই এখন কাপ্তাই হ্রদ। জলবিদু্যৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে সৃষ্ট এই লেক এখন মাছের এক অন্যতম উৎস। এই লেক হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, গুছিয়েছে জীবন। এতদিন মুক্ত জলাশয়ের মাছের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার এই লেকে শুরু হয়েছে আধুনিক পদ্ধতিতে 'খাঁচায় মাছ চাষ'। যা একদিকে বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য সুযোগ তেমনি দেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা।
জানা গেছে, দেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদনের জন্য কাপ্তাই হ্রদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাশয়। কাপ্তাই হ্রদের মোট আয়তন ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর এবং বার্ষিক মৎস্য উৎপাদন ১২৩৪৫ মেট্রিক টন। কাপ্তাই হ্রদের বর্তমান মৎস্য উৎপাদন গতানুগতিক আহরণভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নির্ভর, চাষ নির্ভর নয়। কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, পানির অধিকতর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত এবং মাছ আহরণ বন্ধকালীন সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ একটি যুগোপযোগী প্রযুক্তি।
ইতোমধ্যে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও লংগদু উপজেলায় এই প্রযুক্তি প্রথম। আর তাই মৎস্য অধিদপ্তরাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় চলতি অর্থবছরে লংগদু উপজেলায় জেলেদের মধ্যে বিকল্প আয়বর্ধক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টির জন্য খাঁচায় মাছ চাষের উপকরণ বিতরণ করা হয়।
নতুনভাবে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষি মহর আলী বলেন, সরকারী এই নতুন প্রকল্পের সুবাদে পাহাড়ের মাছ চাষিরা মৎস্য আহরণে বন্ধ মৌসুমেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। তবে প্রকল্প ও প্রণোদনা বাড়ালে প্রান্তিক মৎস্য চাষিরা দ্বিগুণ হারে মাছ চাষে আগ্রহ বাড়বে, ফলে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়বে রাজস্ব আয়। তবে যারা নতুন এ ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করেছেন তারা সকলে সফলতা পাচ্ছেন বলে জানান।
স্থানীয় যুবক ফারুক বলেন, দেশে বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারের এটি একটি সময়োপযোগী ভালো উদ্যোগ। অল্প সময়ে ও খরচে খাঁচায় মাছ চাষে লাভবান হওয়া সম্ভব বলে আগামীতে এ চাষে তরুণ বেকাররা অধিক এগিয়ে আসবে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তানভীর আহসান বলেন, 'সঠিকভাবে চাষ করতে পারলে একটি ১৮ ঘণমিটার আকৃতির খাঁচায় ৪ মাস মাছ চাষ করে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব।'
তিনি আরও বলেন, 'জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রকল্প মেয়াদে আরও কিছু সংখ্যক জেলেদের মধ্যে খাঁচায় মাছ চাষের উপকরণ বিতরণের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ খাঁচায় মাছ চাষে আগ্রহী হলে তাকে উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হবে।'
এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য প্রথমেই খাঁচা তৈরি করতে হয়। লোহার পাইপ কিংবা দন্ড দিয়ে তৈরি প্রতিটি খাঁচার দৈর্ঘ্য ২০ ফুট, প্রস্থ ১০ ফুট ও উচ্চতা ৬ ফুট হতে হয়। ভাসমান অবস্থায় খাঁচায় দুই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়। প্রথমে পদ্ধতিতে খাঁচা স্থাপনের জন্যে খাঁচার মাপের লোহার পাইপ বা দন্ড অথবা বাঁশের তরী হাতলের জাল বেঁধে পানিতে ভাসাতে হয়। তারপর খাঁচার চার কানায় পাথর বা ভারী কিছু যা পানিতে ডুবে যায় এমন বস্তু যুক্ত করতে হয়। যাতে জালের নিচের অংশ টানটানভাবে পানিতে সমানভাবে সারা বছর কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মিটার গভীর পানি থাকে এমন স্থানে খাঁচা তৈরি করতে হয়।
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সারিবদ্ধভাবে চারদিকে বাঁশের বনী তৈরি করে সেখানে জালযুক্ত করে জলাশয়ের পাড় থেকে কিছুটা নিরাপদ দূড়ত্বে রাখতে হবে। যেখানে সারাবছর কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মিটার গভীর পানি থাকে। আর সেখানে শক্ত খুঁটি দিয়ে খাঁচাগুলো বাঁধতে হবে। তবে খাঁচার মধ্যে লোহা ব্যবহার করলে তা ভাসমান রাখতে পস্নাস্টিকের গোলাকার বট ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা শক্ত ড্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, খাঁচায় মাছ চাষ নদী বা জলাশয়ে আধুনিক মাছ চাষের একটি পদ্ধতি। ২০০২ সাল থাইল্যান্ডের অনুকরণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রথম বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার ডাকাতিয়া নদীতে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু হয়। তাই বাংলাদেশে এ ধরনের মাচ চাষ ডাকাতিয়া মডেল নামেও পরিচিত। প্রযুক্তির সুবিধাজনক ব্যবহারের ফলে বাণিজ্যিকভাবে খাঁচায় মাছ চাষ নদীনির্ভর ও সমুদ্র উপকূলীয় প্রায় সব দেশেই জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে খাঁচাকে পুকুরের মতো ব্যবহার করা যায় এবং বিভিন্ন জলাশয়ে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদনের কৌশল হিসেবে এটি বেশ কার্যকর।