লবণ শিল্পে সোনালি দিন

প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
কক্সবাজারের উখিয়ায় লবণ উৎপাদন কাজে ব্যস্ত চাষি -যাযাদি
লবণ উৎপাদনের ভরা মৌসুম হচ্ছে শীতকাল। মাঘের শীত উপেক্ষা করে লাভের স্বপ্ন নিয়ে এখন মাঠে আগাম লবণ উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রান্তিক চাষিরা। এবার আশানুরূপ দাম হওয়ায় লবণ চাষে ঝুঁকেছেন চাষি ও জমির মালিকরা। জেলায় ২০২৩-২৪ সালে লবণ চাহিদার লক্ষ্যমাত্রা ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে প্রায় ২৫ দশমিক ২৮ লাখ মেট্রিক টন। মাঠে নেমেছেন প্রায় ৩৯ হাজার ৪৮৭ জন লবণ চাষি। সারা দেশের লবণের চাহিদার ৮০ ভাগই কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপকূল থেকে মেটানো হয়ে থাকে। প্রতি বছর নভেম্বর মাস থেকে পরের বছরের জুন মাস পর্যন্ত চলে এই লবণ উৎপাদন মৌসুম। জেলার লবণ অন্য উপকূলে উৎপাদিত লবণের চেয়ে উন্নত ও দানাদার হওয়ায় লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি। তাই প্রকৃতির আনুকূল্যে উৎপাদিত এই লবণ শিল্পকে 'সাদা সোনা' হিসেবে অভিহিত করছেন বিশিষ্টজনরা। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে চলতি মৌসুমে আগাম লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমেছেন চাষিরা। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে নির্ধারিত সময়েই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও পুরো দেশের চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত উৎপাদনের আশা করেছেন লবণ চাষি সমিতির নেতারা। তবে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি হলে জেলায় উৎপাদিত লবণের ন্যায্য দাম না পাওয়ার শঙ্কা তাদের। এমনটি হয়ে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত লবণ শিল্প। এদিকে লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হওয়ায় লবণ চাষিদের মাঝে বইছে শান্তির হাওয়া। লবণ চাষের জন্য প্রথমে জমিকে ছোট ছোট ভাগ করে নেওয়া হয়। এরপর ভেজা মাটিকে রোলার দিয়ে সমান করে বিছিয়ে দেওয়া হয় মোটা পলিথিন। সাগরের জোয়ার আসলেই মাঠের মাঝখানে তৈরি গর্তে জমানো হয় লবণ পানি। পরে বালতি ভরে বিছানো পলিথিনের ওপর রাখা হয় এই পানি। কিছুদিন পর জলীয়বাষ্প হয়ে উড়ে যায় পানি, আর মাঠে জমে যায় লবণের আস্তরণ। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যে জানা যায়, ২০২৩-২৪ সালে দেশে লবণের চাহিদা ২৫ দশমিক ২৮ লাখ টন। এ বছর লবণের মূল্য মণপ্রতি ৫২৬ টাকা ও প্রতি মেট্রিক টন মূল্য ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ১৪৬ টাকা। মৌসুমের শুরুতে মাঠ পর্যায়ে বর্তমানে এক লাখ ৭০ হাজার টন লবণ মাঠে মজুত রয়েছে। দেশে প্রতি মাসে লবণের চাহিদা থাকে দুই লাখ ১০ হাজার টন। দেশের লবণের চাহিদার ৮০ ভাগই কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মেটানো হয়। চাষিরা আগাম মাঠে নামায় এবার লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, লবণ শিল্প বিগত ৫ দশকেরও বেশি সময় থেকে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম জেলায় ৬৭ হাজার ৭৫১ একর জমিতে ৩৪ হাজার ৫৫৩ জন চাষি সৌর পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন করছেন। জাতীয় অর্থনীতিতে লবণ শিল্পখাত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার অবদান রাখছে। এ শিল্পের সঙ্গে বিভিন্নভাবে প্রায় চার লাখ মানুষ জড়িত। মহেশখালীর লবণ চাষি আবদুস সালাম বলেন, চলতি মৌসুমে এক একরপ্রতি জমি লিজ নিতে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। মৌসুম শেষ করা পর্যন্ত খাবার, পলিথিন মিলিয়ে খরচ হবে দেড় এক লাখ টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে একরে ৭৫০ মণ লবণ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু লবণের ন্যায্যমূল্য নিয়ে সংশয় কাটে না। শুরু হতে মৌসুম শেষ পর্যন্ত এবার গড়ে ৫০০ টাকার ওপরে লবণ বিক্রি সম্ভব হলে একরে উৎপাদিত লবণে আয় হবে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। গোমাতলি লবণ চাষি সুরতান আহম্মদ বলেন, জমির মালিকদের কাছে জিম্মি লবণ চাষিরা। প্রতি বছর লবণ চাষের জমির ইজারা মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অন্যান্য খরচ। এতে লবণের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় প্রান্তিক চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই লবণ চাষিদের সরকারিভাবে ঋণের পৃষ্ঠপোষকতা করলে ও ন্যায্যমূল্য দিলে এ খাতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে। সরেজমিন লবণ মাঠে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলার উখিয়া ছাড়া ৭ উপজেলার চাষিরা লবণ উৎপাদনে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চাষিরা আনন্দে লবণ উৎপাদন করছেন। জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়ার, গোমাতলি, টেকনাফ, চকরিয়ার ডুলাহাজারা, কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলসহ উপকূলীয় এলাকায় চাষিরা লবণ উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। লবণ চাষকে কেন্দ্র করে ইসলামপুরে রয়েছে ৪০টি রিফাইনারি ফ্যাক্টরি। যার মধ্যে বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫টি সচল রয়েছে। প্রান্তিক চাষিদের একটাই দাবি দেশে যথেষ্ট পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়, কোন চক্র যেন বিদেশ থেকে লবণ আমদানি না করে। লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয় (বিসিক) কক্সবাজারের মাঠ পরিদর্শক ইদ্রিস আলী জানান, সম্প্রতি সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে লবণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর উৎপাদনে আশার আলো দেখছেন তারা। এবার লবণের ন্যায্যমূল্য ৫২৬ টাকা পেয়ে চাষিরা খুশি। কক্সবাজার বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কক্সবাজারের লবণ দিয়ে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব। মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উলস্নাহ রফিক বলেন, একটি চক্র লবণ শিল্পকে ধ্বংস করে সুযোগ নিতে চায়। চাষিরা যাতে লবণের ন্যায্যমূল্য মূল্য পান এজন্য প্রধানমন্ত্রীর নজর রয়েছে।