একই পরিবারের চারজন প্রতিবন্ধী প্রতিবন্ধকতাকে জয় জাকারিয়ার
প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মনজুর হোসেন, মাদারীপুর
দুই পা দিয়ে হাটতে পারে না জাকারিয়া। হাতের গঠনও ভালো না। তাছাড়া শারীরিক গঠনে ছোট। অন্যের সাহায্য নিয়ে চলতে হয় তাকে। তবুও এই প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি মেধাবী কলেজছাত্র জাকারিয়াকে। এবার এইচএসসি পাস করে অনার্সের ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি। পড়াশুনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সির মাধ্যমে প্রতি মাসে আয় করছেন টাকা। তিনি সমাজ ও পরিবারের বোঝা না হয়ে স্বাবলম্বী হতে চান। শুধু তিনি নন। বাবাসহ তার পরিবারের চারজন সদস্যই প্রতিবন্ধী। তারা হলেন- বাবা বাবুল হাওলাদার (৫০), তার বড় ছেলে জাকারিয়া হাওলাদার (২০), মেয়ে লাবণ্য আক্তার (১৫) ও ছোট ছেলে জিহাদ হাওলাদার (১৩)। বাবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে পারলেও তিন সন্তান হাটতে পারেন না। অন্যের সহযোগিতায় চলাফেরা করতে হয় তাদের।
সরেজমিন দেখা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের কুচিয়ামাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী বাবুল হাওলাদারের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনজনই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তারা কেউ হাটতে পারেন না। হাতও বাঁকা। তাছাড়া শারীরিক গঠনও ছোট। শুধুমাত্র একটি সন্তান ভালো আছেন। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায় উঠোনের এককোণে বসে আছেন প্রতিবন্ধী বাবা বাবুল হাওলাদার। আরেকপাশে প্রতিবন্ধী মেয়ে লাবণ্য আক্তার বসে তার মা জোসনা বেগমকে কাজে সহযোগিতা করছেন। আরেক প্রতিবন্ধী জিহাদ হাওলাদার তার এক বন্ধুর সঙ্গে বসে ক্রিকেট খেলছেন। আর জাকারিয়া ব্যস্ত ল্যাপটপে কাজ নিয়ে।
এ সময় তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবুল হাওলাদারের বয়স যখন চার বছর, তখন তার জ্বর হয়। এরপর আস্তে আস্তে তার দুই পা বাকা হয়ে যায়। পা বাকা হলেও তিনি একা একাই চলাফেরা করতে পারেন। বিয়ের পর তার প্রথম সন্তান ছেলে হয়। সবাই আদর করে নাম রাখেন জাকারিয়া। জন্মের পর স্বাভাবিক ছিলেন জাকারিয়া। দেখতেও খুব সুন্দর ছিলেন। বাবার মতো তারও তিন-চার বছর বয়সের পর থেকে জ্বর হয়ে আস্তে আস্তে শারীরিক গঠন বদলাতে থাকে। পা ও হাত আস্তে আস্তে বাকা হয়ে যায়। এরপর মেয়ে লিয়া আক্তার (১৮) সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়। বর্তমানে তার বিয়ে হয়ে স্বামীর সংসারের আছেন। এরপর দুই সন্তান লাবণ্য ও জিহাদের অবস্থাও জাকারিয়ার মতো। একই পরিবারের তিন সন্তানসহ বাবা প্রতিবন্ধী হওয়ায় নেমে আসে চরম অন্ধকার। বাবা ঢাকাতে ফেরি করে খেলনা বিক্রি করে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করেন। তা দিয়ে চালাতে হয় সংসার। নিজের ঘরও নেই। এক চাচা তাদের ঘরে থাকতে দিয়েছেন। এই অভাবের মধ্যেই শুরু হয় জাকারিয়ার জীবন যুদ্ধ। মায়ের অনুপ্রেরণায় জাকারিয়াসহ তার সব ভাইবোন পড়াশুনা শুরু করেন। সুস্থ বোন লিয়া আক্তার এসএসসি পাস করার পর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর আরেক প্রতিবন্ধী বোন লাবণ্য আক্তার স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ও ভাই জিহাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করলেও এখন আর স্কুলে যায় না।
এদিকে জাকারিয়া পড়াশুনা ছাড়েননি। তিনি হাজার কষ্টের মধ্যেও পড়াশুনা করে যাচ্ছেন। প্রথম দিকে তার কোনো হুইলচেয়ার ছিল না। তার মা জোসনা বেগম কোলে করে স্কুলে আনা-নেয়া করতেন। পরে একটি হুইল চেয়ার একজন উপহার দেন। সেই হুইল চেয়ারে করে মা প্রতিদিন বিদ্যালয়ে নেয়া-আনা করতেন। এরপর কলেজে ভর্তি হন। সেখানে ভ্যানগাড়িতে করে কলেজ গেট পর্যন্ত গেলে, কলেজের বন্ধুরা দুইহাত ধরে উঁচু করে ক্লাসরুমে নিয়ে যেত। আবার ছুটির পর একইভাবে তারাই ভ্যানগাড়িতে তুলে দিত। এভাবেই আমি কলেজে আসা-যাওয়া করে এইচএসসি পাস করেন। এখন নিজের পড়াশুনার খরচসহ সংসারের কিছু সহযোগিতার জন্য ফ্রিলান্সিং কাজ করে টাকা আয় করছেন। তা দিয়ে কোনোভাবে চলছে তাদের সংসার।
জাকারিয়ার বাবা বাবুল হাওলাদার বলেন, আমিসহ আমার তিন সন্তানই প্রতিবন্ধী। এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে। তবে জাকারিয়া আমাদের অহংকার। কারণ ও নিজে হাটতে না পারলেও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কম্পিউটারের মাধ্যমে কাজ করে টাকাও আয় করছে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন, জাকারিয়া অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তার পরিবারের জন্য আমরা সব ধরণের সহযোগিতা করব। তাছাড়া খুব মিগগিরই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে টাকা আয়ের জন্য ৬ মাসব্যাপী একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে। সেখানে জাকারিয়াকে সুযোগ দেওয়া হবে। ও যদি ভালো করতে পারে, তাহলে ওর জন্য কাজেরও ব্যবস্থা করা হবে।