চাহিদা বেশি হওয়ায় রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে দিনাজপুর জেলার কৃষকদের। ইতোমধ্যে এসব রঙিন সবজি চাষ করে সফলতাও পেয়েছেন তারা। চাহিদা ও দাম বেশি থাকায় লাভবান হচ্ছেন কৃষক। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
দিনাজপুর প্রতিনিধি : দিনাজপুরের বাজারে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন দুই মৌসুমেই সবজি হিসেবে সাধারণ ফুলকপি-বাঁধাকপির দেখা মেলে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে জেলায় সাধারণ ফুলকপি-বাঁধাকপির বিপরীতে চাষ হচ্ছে ক্যারোটিনা (গাঢ় হলুদ), ভেলেন্ডিনা (পার্পেল রং) ফুলকপি ও রবি কিং (পার্পেল) জাতের বাঁধাকপি। রঙিন এসব সবজিতে একদিকে ক্রেতাদের আকর্ষণ ও চাহিদা বেড়েছে, অন্যদিকে ভালো দাম পাওয়ায় এসব চাষে কৃষকেরও আগ্রহ বাড়ছে।
দিনাজপুরে গত বছর স্থানীয় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো কৃষককে রঙিন ফুলকপি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এবার কৃষিবিভাগ জেলায় টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উচ্চ মূল্যের নিরাপদ সবজি চাষ প্রকল্প চালু করেছে। প্রকল্পের আওতায় কৃষক পেয়েছেন সার-বীজের সহায়তা। ফলে বেশি উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে কৃষকরা রঙিন কপি চাষের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের সবজি যেমন স্কোয়াশ, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলিসহ নানা পদের সবজি চাষ করেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জ্ঞান দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চমূল্যের নিরাপদ ফসল উৎপাদন, পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ ও খোরপোশ কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করাই গৃহীত প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। জেলায় রবি মৌসুমে ২ হাজার ১৪ হেক্টর জমিতে বাঁধাকপি এবং ২ হাজার ১৬৬ হেক্টর জমিতে ফুলকপির চাষ হয়েছে। গত বছর জেলায় শূন্য দশমিক পাঁচ হেক্টর জমিতে রঙিন কপির চাষ হয়েছিল। এবার প্রকল্পের আওতায় ৫২ জন কৃষক (প্রতিজন ২০ শতক করে) প্রায় ৩৫ বিঘা জমিতে রঙিন কপির চাষ করেছেন।
সদর ও চিরিরবন্দর উপজেলার কয়েকজন কৃষকের ক্ষেত ঘুরে দেখা যায়, সারিসারি সবুজ ফুলকপির গাছ। পাতার আড়ালে বসে আছে সাদা, হলুদ, গোলাপি, কমলা রঙের ফুলকপি। গাঢ় বেগুনি, সবুজ, লাল রঙের বাঁধাকপি। ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়া সাধারণের দৃষ্টি কাড়ছে। গাছের পাতা খাওয়ার লোভে ক্ষেতজুড়ে কিচিরমিচির শব্দে পাখিদের ভিড়।
চিরিরবন্দর উপজেলার বলাই বাজার গ্রামের সবজি চাষি মফিজুল রহমান অন্য সবজির পাশাপাশি এবারই প্রথম ২০ শতক জমিতে রঙিন ফুলকপির চাষ করেছেন। গাছের বয়স হয়েছে ৭২ দিন। প্রতিটি গাছে সবুজ পাতার ফাঁকে ঘাপটি মেরে আছে ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের কপি। কপির পাইকারি দাম পাবেন ৪৫-৫০ টাকা, ওজন ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি হলে দাম পাবেন ৫৫-৬০ টাকা।
মফিজুল বলেন, '২০ শতক জমিতে দেড় হাজার কপি আছে। যদি এক হাজার কেজি ফসল ৫০ টাকা কেজি দাম পাই তাহলে কপি বিক্রি হবে ৫০ হাজার টাকার। যেখানে অন্য ফসল আবাদ করলে তিন ভাগের এক ভাগ লাভ পেতাম। কৃষি বিভাগ থেকে সার-বীজ-জৈব বালাইনাশক পেয়েছি। পাশাপাশি খরচ পড়েছে ১০-১২ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়েও লাভ থাকবে প্রায় ৪০ হাজার টাকা।'
গত বছর দুই একর জমিতে ফুলকপি-বাঁধাকপি ও ব্রোকলির চাষ করেছিলেন সদর উপজেলার জঙ্গলপাড়ার কৃষক আলামিন হোসেন। এবার শুধু রঙিন কপিই চাষ করেছেন ৭০ শতক জমিতে।
আলামিন জানান, এসব জমিতে সাধারণত আলু লাগাতেন। আলুতে ঝুকি বেশি। বাজারও উঠানামা করে। গত বছর প্রথমবার রঙিন ফুলকপি চাষে লাভ পেয়েছেন। এবারও লাগিয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রথম দফায় বিক্রিও করেছেন।
মঙ্গলবার দিনাজপুর বাহাদুর বাজারে আসা সবজি ক্রেতা সজিব বলেন, 'স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গোলাপী রঙের কপির ছবি দেখে আমাকে কিনতে বলেছে। আজ বাজারে এসে কিনলাম। সাধারণ কপির চেয়ে ১০ টাকা দাম বেশি পড়ল। তবে শুনেছি খেতে নাকি অনেক সুস্বাদু। ভালো জিনিসের দাম তো একটু বেশিই পড়বে।'
দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবু রেজা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, এ অঞ্চলের কৃষি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। মূলত আধুনিক পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিতকরণ, পুষ্টিমান কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে রঙিন সবজিতে ভিটামিন এ, সি, আয়রন, খনিজ উপাদানের পরিমাণ সাদাকপির তুলনায় বেশি থাকে। এতে এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফসলে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করায় ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের আস্থাও বাড়ছে। এই কপি আবাদে লাভবান হচ্ছেন এ অঞ্চলের কৃষক।
বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তবে যুগে যুগে কৃষি কাজে আধুনিকায়ন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কৃষিতে ব্যাপক বিপস্নব সাধিত হয়েছে।
আর এই বিপস্নব সাধনের সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের। তারা ঝড়-বৃষ্টি, রোদ, দিনের পর দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ও বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে ফসল ফলান। যার ফলে কৃষিতে আসছে পরিবর্তন, হচ্ছে উন্নয়ন।
এই ধারাবাহিকতায় দিনাজপুরের বীরগঞ্জের অধিকাংশ কৃষক এ বছর তাদের পতিত জমিতে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে সারাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। তবে এবার এই অঞ্চলের টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় প্রথমবারের মতো দেখা মিলল একটু ব্যতিক্রমী শীতকালীন সবজি রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষ। কোনোটির রং হলুদ, আবার কোনোটির রং বেগুনি। আর এসব ফুলকপি ও বাঁধাকপি কোনো প্রকার কীটনাশক ছাড়াই শুধুমাত্র জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে চাষ করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের আওতায় উপজেলার সবজিগ্রাম নামে খ্যাত সাতোর ইউনিয়নের প্রাণনগর গ্রামের কৃষক শামীম ইসলাম তার ২০ শতক জমিতে ক্যারোটিন জাতের রঙিন ফুলকপি চাষ করে ব্যাপক লাভবান হয়েছে।
শামীম ইসলাম জানান, 'এ বছর কৃষি অফিসের সহায়তায় রঙিন ফুলকপি চাষ করেছি। বাম্পার ফলন হয়েছে, কোনো রোগ বালাই নেই, খরচ কম। শুধুমাত্র জৈব বালাইনাশক ও ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারেই আমি এই ফুলকপি চাষ করেছি। অন্য ফুলকপির তুলনায় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা ও দামও ভালো। স্থানীয় বাজারে প্রতিটি ফুলকপি ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি করছি। এ কপি চাষে আমার খরচ হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টাকা। বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় ফুলকপি বিক্রি করে খরচের টাকা উঠে এসেছে। মাঠে এখনো এক হাজার ফুলকপি রয়েছে।'
একই কথা জানিয়ে উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নের দামাইক্ষেত্র গ্রামের নির্মল চন্দ্র রায় জানান, 'রঙ্গিন বাঁধাকপি আমি আগে কখনো দেখিনি। এ ব্যাপারে কৃষি অফিসের উদ্যোগে পরীক্ষামূলকভাবে ২০ শতক জমিতে বাঁধাকপি আবাদ করি। ব্যাপক ফলন হয়েছে। দাম বেশ ভালো। প্রতিটি কপি বাজারে ১৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকার বাঁধাকপি বিক্রি করেছি। বাজারে অন্য কপির তুলনায় রঙিন কপির চাহিদা বাড়ছে। এখন যা আছে খরচ বাদ দিয়ে এতে বেশ লাভ হবে।'
এ ব্যাপারে বীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ শরিফুল ইসলাম জানান, এবার উপজেলায় ক্যারোটিনা জাতের রঙ্গিন ফুলকপি ও বাঁধাকপি পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হয়েছে এবং বাম্পার ফলন হয়েছে। অনেক কৃষক এই ফুলকপি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আগামী বছর উপজেলায় এই ফুলকপি চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হবে।
দিনাজপুর অঞ্চলের টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আবুরেজা মো. আসাদুজ্জামান জানান, এ বছর দিনাজপুর জেলায় সাড়ে ৪ হেক্টর জমিতে রঙ্গিন ফুলকপি ও বাঁধাকপি আবাদ হয়েছে। ভোক্তাদের মাঝে নিরাপদ উচ্চমানের সবজি উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কৃষি অফিস কৃষকদের পাশে থেকে সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদানে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।