পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ (রামেক)। প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে প্রথম পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয় রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট ভবনে। শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পর দীর্ঘ ৯ বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাস আলোরমুখ দেখেনি।
দেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের স্থাপত্য কার্যক্রম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগ করে থাকলেও রামেকের দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এদিকে, রাঙামাটি জেলা শহরের রাঙাপানি এলাকায় ২৬ একর জমি অধিগ্রহণ হলেও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পাস না হওয়ায় শুরু করা যায়নি স্থায়ী ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ। মেডিকেল কলেজের অবকাঠামোগত সংকট ও শিক্ষা উপযোগী পরিবেশের প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। যে কারণে মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ায় বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বদলাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা- এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রামেক একাডেমিক শাখা সূত্রে জানা গিয়েছে, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ২০১৪-১৫ সেশনে প্রথম একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিটি ব্যাচে ৫১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। আবার ৫১টি আসনের মধ্যে ১৫টি সংরক্ষিত আসন বা কোটা রয়েছে। ১৫টির মধ্যে ১৩টি তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা শিক্ষার্থীদের কোটা, একটি মুক্তিযোদ্ধা ও আরেকটি সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা। ১৩টি পার্বত্য কোটার মধ্যে আবার ১০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ৩টি বাঙালি কিংবা অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য। আবার পার্বত্য কোটায় ভর্তি হওয়া ১৩ জন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মাইগ্রেশনের কোনো সুযোগ নেই। যদিও বিগত ৯টি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশন নেওয়ার তথ্যে দেখা যায়- ৫১ জন শিক্ষার্থীর আসন থাকলেও দুইটি ব্যাচে সর্বোচ্চ ৪৬ জন ও আরেকটি ব্যাচে ৪৫ জন শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন নিয়ে অন্য মেডিকেল কলেজে বদলি হয়েছেন।
মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ার নিয়ম অনুযায়ী ৫১টি আসনের মধ্যে পার্বত্য তিন জেলার ১৩টি সংরক্ষিত আসনের শিক্ষার্থীরা কেবল মাইগ্রেশন নিতে পারবেন না। সে হিসেবে ৫১ জনের মধ্যে মাইগ্রেশন নিতে পারবেন কেবল ৩৮ জন। কিন্তু মেডিকেল কলেজের তথ্যে দেখা গিয়েছে, তিনটি ব্যাচেই সবোচ্চ ৪৫ ও ৪৬ জন শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন তিনটি ব্যাচেই মাইগ্রেশন নিয়েছেন। মাইগ্রেশনের তিনবার সুযোগ থাকায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে মাইগ্রেশনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরাও ফের এখান থেকে মাইগ্রেশন নিয়ে অন্যত্র বদলি হয়েছেন।
এদিকে, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ডা. শহীদ তালুকদার নামে সিভিল সার্জন পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ২০১৪-২১ সাল পর্যন্ত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এরপর ২০২১-২৩ পর্যন্ত রাঙামাটির তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা অতিরিক্ত দায়িত্বে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসার বদলিজনিত কারণে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পদবি শূন্য হয়। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. অংসুইপ্রম্ন মারমাকে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক যোগদান না করায় ২০ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে লিখিত চিঠি দিয়েছে রামেক। বর্তমানে প্রায় সাত মাস ধরে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পরিচালক পদটিও শূন্য রয়েছে। নানা সংকটের কারণে রামেকের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।
রামেকের নবম ব্যাচ ও প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী সিং এ মং মারমা বলেন, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা সুযোগ নেই। প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাস না থাকায় থাকতে হচ্ছে আশপাশের বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষক সংকট নেই, পর্যাপ্ত ক্লাসও হচ্ছে। মেডিকেলের একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠার চালুর ৯ বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে না পারা এবং এটির কোনো অগ্রগতি না থাকা সত্যিই দুঃখজনক।
একই অভিযোগ জানালেন একই বর্ষের শিক্ষার্থী জাকিয়া আফরিন। জাকিয়া জানান, 'আমরা এখানকার স্থায়ী হওয়ায় নিজের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে পারছি। কিন্তু যারা বিভিন্ন জেলা থেকে পড়াশোনা করতে এসেছেন; তাদের মধ্যে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বাইরেই ভাড়ায় থাকতে হয়।'
রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের (২০১৫-১৬ সেশন) শিক্ষার্থী ছিলেন অর্ণব বড়ুয়া। তিনি বলেন, 'এমবিবিএস পাস করার পর ইন্টার্নি করতে হচ্ছে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে, এই হাসপাতালে অনেক কিছুরই সংকট। সার্জারি বিভাগের নাক, কান, গলা (ইএনটি) ও চোখের অপারেশন ও নিরীক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। অনেক সার্জারি যন্ত্রপাতির অভাবে করা যাচ্ছে না। গাইনি, ইএনটি সব মিলিয়ে একটি অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) তিনটি বেডে এতগুলো অপারেশন কার্যক্রম চালানো কঠিন। যে কারণে তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় রোগীর শরীরেও ইনফেকশন হয়। '
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি মেডিকেল হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক প্রীতি প্রসূন বড়ুয়া বলেন, 'এমবিবিএস পাস করা শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নির ক্ষেত্রে খুব অসুবিধা হচ্ছে না বলা যায়। ২০১৪-১৫ সালে একাডেমিক কার্যক্রম চালু হলেও ডিপিপি পাস হয়নি এটি সত্য। ডিপিপি পাসের বিষয়টি দেখেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।'
অধ্যাপক প্রীতি প্রসূন বলেন, 'আমাদের এখানে এখন প্রকল্প পরিচালকের পদটি শূন্য রয়েছে। সম্প্রতি একজনকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও তার বর্তমান প্রতিষ্ঠান তাকে রিলিজ না দেওয়ায় তিনি এখানে যোগদান করতে পারেননি।'
শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশন প্রসঙ্গে বলেন, 'প্রথম বর্ষে ভর্তির পর তিনবার মাইগ্রেশনের সুযোগ থাকে। মাইগ্রেশনের মূল কারণ প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী তার নিজের এলাকার আশপাশের মেডিকেল কলেজেই লেখাপড়া করতে যান। এটিই মাইগ্রেশনের প্রধান কারণ।'