ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা

চকরিয়ার ডুলাহাজারায় সংরক্ষিত বনে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন

প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

মুহাম্মদ মনজুর আলম, চকরিয়া (কক্সবাজার)
কক্সবাজারের চকরিয়ার ফাসিয়াখালী রেঞ্জের ডুলাহাজারা বন বিটের সংরক্ষিত বনের ভেতর ড্রেজার ও শ্যালোমেশিন বসিয়ে তোলা হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ বালু -যাযাদি
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের চকরিয়ার ফাসিয়াখালী রেঞ্জের ডুলাহাজারা বিটের সংরক্ষিত বনের ভেতর চলছে পরিবেশবিধ্বংসী অপতৎপরতা। সংরক্ষিত বনে শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালোমেশিন বসিয়ে তোলা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ বালু। আর এ বালু উত্তোলনে রয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ ১২০ সদস্যের একটি শক্তিশালী বালুদসু্য সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে সংরক্ষিত বনের বগাচতর, ডুলহাজারা, দাঙ্গার বিল, বগাছড়ি, পাগলীর বিল মৌজার অন্তত ৩০টি পয়েন্টে এস্কাভেটর দিয়ে পাহাড়ি টিলা কেটে এবং শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালোমেশিন বসিয়ে ৩০-৪০ ফুট গভীর থেকে তোলা হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ বালু। আর এসব উত্তোলিত বালু ছোট ডাম্পার গাড়িতে বনের ভেতর থেকে এনে সড়কের পাশে সমান্তরাল জায়গায় স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। সেখান থেকে বড় ট্রাকে করে পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। জানা গেছে, কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের আওতাধীন ডুলাহাজারা বন বিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বগাচতর, ডুলহাজারা, দাঙ্গার বিল, বগাছড়ি ও পাগলীর বিল মৌজার ওপর দিয়ে বহমান দু'টি ছড়াখাল তথা কথিত বালু মহাল ইজারা নেওয়ার নামে ২০১৯ সাল অতৎপরতা শুরু করে প্রভাবশালী বালু দসু্যরা। এসব বালু মহাল ইজারা দেওয়ার সময় ইজারাদারদের প্রশাসনের পক্ষ বালু উত্তোলনের নির্দিষ্ট সীমানা বেধে দেওয়া হয়। তবে তারা তা অমান্য করে উপরোক্ত মৌজার পাহাড়ি টিলা অবৈধভাবে কেটে বালু লুটের উৎসবে মেতে উঠেছে। সে সময় বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ?্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষায় উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস)। এ সময় আদালত অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়টি বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ও বিধিমালা বহির্ভূত হওয়া কেন অবৈধ, আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ও জনস্বার্থ বিরোধী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় ও দোষীদের কাছ থেকে তা আদায় এবং বালু মহালগুলো ও পাশের এলাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক এবং সংরক্ষিত বনভূমি রক্ষায় রুল জারি করেন। মামলার বিবাদী ভূমি ও পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সচিব, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, বনবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে এ রুল জারি হয়। এ সময় আদালত বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠিত একটি প্রভাবশালী বালুদস?ু্য সিন্ডিকেট সশস্ত্র পাহারা বসিয়ে সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করছে। বালু নির্বিঘ্নে পরিবহণের জন্য সড়কের পাশে মোড়ে মোড়ে বিশাল আকারের স্তূপ করে রেখেছে। পরে বনবিভাগ, প্রশাসন বা অন্য কোন সংস্থার লোকজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বড় ট্রাকে দেশের বিভিন্নস্থানে পাচার করছে। অভিযোগ উঠেছে- বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই সংরক্ষিত বনের ভেতর পরিবেশ বিধ্বংসী এই কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী বালুদস?ু্য সিন্ডিকেট। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও ডুলাহাজারায় সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ব?্যাপারে ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মেহরাজ বলেন, সংরক্ষিত বনের 'কোথাও এমন কর্মকান্ড সংঘটিত করা হচ্ছে কিনা তা আমার জানা নেই।' ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল উচ্চতর আদলতে এ সংক্রান্তে রুল জারির বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, 'সে সময় পরিবেশবিধ্বংসী এই কর্মকান্ড বন্ধে মহামান্য হাইকোর্ট রুল জারিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেন। পরে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি (বর্তমানে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী) সাবের হোসেন চৌধুরীর দপ্তরে ডাকা হয় কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, বনবিভাগের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (ডিএফও) এবং আমাকে। সেখানে অবৈধ বালু উত্তোলনের ব?্যাপারে কঠোর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং বনবিভাগের একের পর এক অভিযানের ফলে বন্ধ হয়ে যায় বালু দসু্যদের অপতৎপরতা।' বর্তমান অবৈধ বালু উত্তোলনের ব?্যাপারে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, 'পরিবেশবাদী সংগঠনের রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় পাগলির ছড়া ও বগাছড়ি ছড়ার কথিত বালু মহাল ইজারা বন্ধ রয়েছে। তবে পুরনো কায়দায় নতুন করে আবারও ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে বালু উত্তোলনের মহাকর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে চকরিয়া ইউএনও ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'কোন অবস্থাতেই বনের ভেতর পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকান্ড কাউকে সংঘটিত করতে দেওয়া হবে না। এই কর্মকান্ডের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'