শীত কুয়াশায় এখানে আলুক্ষেত নষ্ট, বোরো বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি কুয়াশায় অন্ধকার রাস্তায় পরষ্পরকে দেখতে না পেয়ে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে মুচড়ে যাওয়া দুটি গাড়ির ৮ জন মারাত্মক আহত, প্রতিদিন হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ চারগুণ শীতজনিত রোগীভর্তি হয়েছেন। তবুও শীতের এই ভয়াবহতা স্বত্বেও ঠাকুরগাঁওয়ে কখনই চিহ্নিত হয়নি দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। অথচ ভৌগোলিকভাবে এ মৌসুমে সবচাইতে বেশিসময় বা উলেস্নখযোগ্য সময়জুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় নেমে যাওয়া পঞ্চগড়ের সবচেয়ে কাছের জেলা হলেও ঠাকুরগাঁও। কখনই উলেস্নখ হচ্ছে না সর্বনিম্ন তাপমাত্রার এলাকা হিসেবে।
ঠাকুরগাঁওকে অতিক্রম করে হিমালয় থেকে অনেকটা দক্ষিণের জেলা হলেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চিহ্নিত হয়েছে রংপুর দিনাজপুরে। যদিও বরফজমাট হিমালয়সংলগ্ন দেশের অন্যতম সর্ব উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও, অনেক আগে থেকেই শীতপ্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে সদর ছাড়া বাকি চারটিতেই হিমালয়-কাঞ্চন জংঘার দেশ ভারতের শীতপ্রধান এলাকার সঙ্গে সীমান্ত ঘেঁষা। ঠাকুরগাঁওবাসীর অভিযোগ, আবহাওয়া অফিস না থাকায় এই বিভ্রাটটি ঘটছে এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে জনদুর্ভোগের প্রকৃত চিত্র পৌঁছাতে সমস্যা হচ্ছে।
দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়। হিমালয়ের পাশাপাশি ও সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় এ জেলায় শীতের প্রকোপ বেশি থাকে। সবার আগে শীত এসে মাঝখানে জেঁকে বসে। আবার সবার পরে শীত বিদায় নেয়। তবে পঞ্চগড়ের পাশাপাশি শীতের জেলা হলেও ঠাকুরগাঁওবাসী জানতে পারেন না কোন দিন কত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দিন কাটে তাদের। এতে করে ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষক ও পেশাজীবীরা। শীতের কারণে জনদুর্ভোগ কমাতে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রেও এই আবহাওয়া অফিস বা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকা জরুরি।
শীতের দাপটে এ জেলার মানুষ অনেক আগে থেকেই অভ্যস্ত হলেও এবারের তীব্র শীত যেন সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। পুরোপুরি বিপর্যস্ত জনজীবন। চলতি শীত মৌসুমের শুরুতে তেমন নাজেহাল না হলেও জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে শৈত্যপ্রবাহ ঘনকুয়াশায় বিপর্যয়কর শীতের প্রকোপে পড়েছেন জেলার মানুষ। সারা দিন ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত চারপাশ আর হিমালয়ের হিম শীতল বাতাসে স্থবির হয়ে পরেছে জনজীবন।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত ২৮ জানুয়ারি জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত পাঁচ মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এটি। অথচ আবহাওয়া অফিস না থাকায় সঠিক তাপমাত্রার তথ্য বিভ্রান্তিতে পড়েছেন সাংবাদিকসহ জেলার মানুষ।
আবহাওয়া অফিস না থাকার ফলে, গণমাধ্যম কর্মীরা সঠিক তাপমাত্রার খবর প্রচার করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সেই সঙ্গে ক্ষতি হচ্ছে কৃষক, পশু-পাখি পালক ও খামারি এবং মৎস্য চাষিদের। অনেক চাষির বীজের জন্য করা আলু ক্ষেতে পচন ধরেছে ও বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তীব্র শীতের নানারোগে ঝিমিয়ে পড়েছে বা মারা গেছে মুরগি, গরু-ছাগল। সারা দেশে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কথা থাকলেও সঠিক তথ্যের অভাবে বন্ধ হচ্ছে না এখানকর প্রতিষ্ঠান। এতে করে তীব্র শীতেও শিক্ষার্থীদের আসতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে।
ঠাকুরগাঁও প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান মিঠু বলেন, 'আমরা এটা কখনো কখনো অনুভব করেছি যে, এ জেলার মানুষ সবচাইতে বিপর্যয়কর শীতে পড়েছে। কিন্তু কখনই এটা আমাদের মিডিয়ায় দেখাতে পারিনি যে এখানকার তাপমাত্রা কতটা নিচে নেমে গেছে। এর কারণ আবহাওয়া অফিস না থাকা।'
ঠাকুরগাঁও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আকতার হোসেন বলেন, আবহাওয়া অফিস না থাকায় স্কুল বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। নির্দেশনা অনুযায়ী ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রাখার কথা রয়েছে। গত সপ্তাহের শেষ দুই দিন আমরা বন্ধও রেখেছিলাম। বর্তমান সপ্তাহেও একই কারণে স্কুল বন্ধ করার দাবি উঠলেও আমরা নির্ভুল তাপমাত্রার রিডিংয়ের অভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবহাওয়া অফিস হলে আগে থেকে জেলার সমস্ত অঞ্চলের পূর্বাভাস জেনে কৃষি ক্ষেত্রে করণীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। এতে করে কৃষকরা ফসলের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
এদিকে জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলা ছাড়া বাকি চারটি উপজেলাই হিমালয়-কাঞ্চন জংঘার দেশ ভারতের শীতপ্রধান এলাকার সঙ্গে সীমান্ত ঘেঁষা। আর সীমান্ত ঘেঁষে থাকা দরিদ্র জনপদে শীতের সময় ত্রাণ নিয়ে ছুটে যান সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি। মহাশীত উপেক্ষা করে রাতদিন সীমান্ত পাহাড়ার দায়িত্বে থাকা বিজিবি সদস্যদেরও ভোগান্তি বাড়ে এই শীতে। তাই দেশরক্ষার অতন্দ্র প্রহরীদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও আবহাওয়া অফিসের গুরুত্বের কথা স্বীকার করেন ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল তানজির আহম্মদ।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আমাদের কৃষির জন্য, পশু বা মৎস্যসম্পদ সবকিছুর জন্যই সুনির্দিষ্টভাবে আবহাওয়ার তথ্য জানা দরকার। বিশেষ করে তাপমাত্রা যখন অনেক নিচে নামে তখন স্বাস্থ্যগত ও অন্য কারণেও আবহাওয়ার তথ্য জানা জরুরি। তাই জেলা প্রশাসন অনুধাবন করেছে এখানে একটি আবহাওয়া অফিস বা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রয়োজন। এ ব্যাপারে শিগগিরই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পত্র যোগাযোগ করা হবে।