গৃহবধূ শাপলা বেদ। এক মনে বাঁশ কঞ্চি আর বাঁশ থেকে ছোট ছোট সরু চটা প্রস্তুত করছেন। এরপর তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাতের নিখুঁত ছোঁয়ায় তৈরি করছেন ছোট ছোট ঝুড়ি শর্পেসসহ প্রয়োজনীয় নানা ধরনের গৃহস্থালী সামগ্রী। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি সপ্তাহে তিনি ৫০-৬০টি ঝুড়ি ও শর্পেস তৈরি করেন। তৈরি এসব সামগ্রী বিক্রি করা হয় পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন হাটে। এসব পণ্য বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থে চলে সংসার। শাপলা বেদ ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কয়েরগাছী আবাসন ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা।
তার মতো ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কয়েরগাছী আবাসন ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা বেদ বংশের অন্তত ২০ পরিবারের প্রায় ৩০ জন সদস্য এই কুটির শিল্পের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা খেলনা কুলা, মুড়ি খাওয়ার ডোল, হাতপাখা, ঝুড়ি, ভাত ও তরকারি ঢাকার কাজে ব্যবহৃত শর্পেস, মাছ ধরার বিভিন্ন খালুইসহ সামগ্রী তৈরি করেন। নারীদের তুলনায় পুরুষরা প্রায় দ্বিগুণ কাজ তুলতে পারেন।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহের শুরুতেই আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে বিশেষ ধরনের তলস্না বাঁশ আকার ভেদে ১০০-১৫০ টাকা কখনো এরও বেশি দরে প্রতিজন গড়ে ১০-১৫টি বাঁশ কিনে আনেন। এই বাঁশ সাইজ করে কেটে মসৃণ চটা তৈরি ও চিকন কঞ্চি তোলা হয়। সেগুলো কিছু সময় রোদে শুকানো হয়। এরপর বাজার থেকে পছন্দ মতো হাজার পাওয়ারের রং কিনে এতে দেওয়া হয়। রংকরা শেষে আবার রোদে শুকানো হয়। শুকানো শেষে তা কাজ করার উপযুক্ত হয়। এই হস্তশিল্পের চাহিদাও নেহাত কম নয়। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে লভ্যাংশ এখন কিছুটা কম বলে জানালেন তারা।
একটা কুলা তৈরিতে খরচ গড়ে ১৫-২৫ টাকা, ডালা ৩৫-৪০ টাকা, ছোট খেলনা ডোল ১০ টাকা, ঝুড়ি ২০-৩০ টাকা, পাখা ৩০ টাকা। খরচের তুলনায় স্থান ভেদে ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা লাভে বিক্রি করেন তারা। তাদের তৈরি এই বাঁশের সামগ্রী চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পাঠানো হয়। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যরা সপ্তাহ ধরে তৈরির পর মাল নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে, শহরে, চর এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করেন। তবে প্রতি শুক্রবার জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার হাটেও বিক্রি করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময় জেলা সদরের তেতুলতলাসহ আশপাশের এলাকায় বেদে সম্প্রদায়ের মতো তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করতেন বেদ বংশের মানুষ। পরে ২০০৩ সালে কয়েরগাছী এলাকায় আবাসন প্রকল্প হলে সেখানে আশ্রয় হয় তাদের। সাম্প্রতিক সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরেও নিরাপদ বসতি হয়েছে তাদের অনেকেরই। এই সম্প্রদায়ের আদি পেশা হচ্ছে বাঁশের সামগ্রী তৈরি করা।
কয়েরগাছী আশ্রয়ণের বাসিন্দা শাপলা বেদ বলেন, '১২ বছর ধরে এই কাজ করছি। ডালা, শরপেস, কুলা বিভিন্ন স্থানে বেচাবিক্রি হয়। ঢাকার পার্টিও পাইকারি কিনে নিয়ে যায়। এগুলো বিক্রি করে যে লাভ হয়, তা দিয়েই সংসার চলে। এই লাভের টাকা দিয়েই তিনি বড় মেয়ে অপর্ণা বেদকে পড়াচ্ছেন স্থানীয় একটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে। ছোট মেয়ে অন্নপুর্ণা এখনো স্কুলে যাওয়ার মতো হয়নি। '
অপর নারী ঝিলিক জানান, প্রথমে চটা দিয়ে ঝুড়ির তলা তৈরি করা হয়। এরপর তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বানানো হয় পূর্ণাঙ্গ ঝুড়ি। তৈরি শেষে সেগুলো পুরুষরা বিভিন্ন হাটে বিক্রি করেন।
রাজু কুমার ও আনন্দ কুমার জানান, চাহিদা ভালো থাকলেও আগের তুলনায় লাভ হয় না। পস্নাস্টিক পণ্য ও পুঁজি সংকটে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে আদি এই পেশার মানুষ। এ ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন বলেও জানান তারা।
স্থানীয় মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খুরশিদ আলম বলেন, 'আবাসন ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের যাযাবর জীবনের অবসান হয়েছে। এখানে থেকেই তারা কুলা, ডালাসহ বাঁশের সামগ্রী তৈরি করছেন। কিন্তু পস্নাস্টিকের কারণে এই পেশা কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়েছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাদের এই জীবিকার উৎস বৃদ্ধির পাশাপাশি কুটির শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে।'