অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে খাবার তৈরি
বেকারি পণ্যের নামে 'বিষ' কিনে খাচ্ছেন মানুষ!
প্রকাশ | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
কাপড় ও কাঠের রং ব্যবহার করা হচ্ছে বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, মিষ্টিসহ নানা রকমের খাবার তৈরিতে। বেকারি পণ্যের নামে আসলে আমরা কি খাচ্ছি রাজধানীর কেরানীগঞ্জে বেশিরভাগ বেকারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণেও রয়েছে চরম অব্যস্থাপনা। এ ছাড়াও পণ্য রাখার ঘর যেমন অপরিষ্কার। পোকামাকড়েও ভরপুর। সর্বোপরি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স। থাকলে মান বজায় রেখে উৎপাদন করা হচ্ছে না। অনুমোদন ছাড়াই বেকারি পণ্যের উৎপাদন এখন নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে মানবস্বাস্থ্যের বিষয়টি এখন হুমকির মুখে পড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ বেকারির নেই ট্রেড লাইসেন্স, বিএসটিআই, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ, স্যানিটারি ও ট্রেডমার্ক ছাড়পত্র। ফলে তদারকির অভাবে উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বেকারি। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এসব খাদ্য মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কেরানীগঞ্জ উপজেলার শুভাঢ্যা, আগানগর, তেঘরিয়া, বাস্তা, রোহিতপুর, শাক্তা এবং কালিন্দী গদাবাগ এলাকাসহ ইউনিয়নগুলোর আনাচেকানাচে অসংখ্য বেকারি গড়ে উঠেছে। সরকারি অনুমতি ছাড়াই মানহীন পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করছে এসব বেকারি। এসব বেকারিতে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পাউরুটি, মিষ্টিসহ নানা মুখরোচক পণ্য। সঁ্যাতসেঁতে নোংরা পরিবেশে ভেজাল ও নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে অবাধে তৈরি করা হচ্ছে বেকারিসামগ্রী। বেকারিতে ব্যবহৃত জিনিসগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। শ্রমিকরা খালি পায়ে এসব পণ্যের পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। এ সময় তাদের গা থেকে ঘাম ঝরে পণ্যের ওপর পড়তে দেখা গেছে। আটা-ময়দা প্রক্রিয়াজাত করার কড়াইগুলোও অপরিষ্কার ও নোংরা। ডালডা দিয়ে তৈরি করা ক্রিম রাখা পাত্রগুলোতে ভন ভন করছে মাছির ঝাঁক। কয়েক দিনের পুরনো তেলেই ভাজা হচ্ছে পণ্যসমাগ্রী। অপরিচ্ছন্ন হাতেই প্যাকেট করা হচ্ছে এসব পণ্য। উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ছাড়াই বাহারি মোড়কে বিভিন্ন ধরনের বেকারিসামগ্রী বাজারজাত করা হচ্ছে।
উপজেলার আব্দুলস্নাহপুর এলাকার খাদিজা বেকারি অ্যান্ড কনফেকশনারিতে দেখা যায়, আট থেকে ১০ বছরের শিশুদের দিয়ে করানো হচ্ছে ভারী কাজ। বেকারির মালিক ডালিম আহমেদের কাছে বেকারি চালানোর সরকারি অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, 'আগে আছিল, এখন নেই। বহু বছর ধরেই লাইসেন্স ছাড়া বেকারির ব্যবসা করে আসছি।' বেকারির এক কর্মচারী শামীম বলেন, দিনের বেলায় তারা পণ্য উৎপাদন করেন না। রাতে শুরু করে ফজরের আগেই উৎপাদন কাজ শেষ করেন। সকালে ভ্যানগাড়ি করে দোকানগুলোতে সাপস্নাই করা হয়।
শুধু খাদিজা বেকারি নয়, উপজেলার তিতাস বেকারি, স্টার বেকারি, জনতা বেকারি, ঢাকা নূর বেকারি, মায়ের দোয়া বেকারি, মজিদ বেকারি এবং মিম বেকারিতেও মিলবে একই চিত্র। এসব না জেনেই খাবার কিনে খাচ্ছেন ক্রেতারা। ক্রেতারা জানান, খাবারে এমন ভেজাল মেনে নেওয়া যায় না।
অনিয়মের কথা স্বীকার করে বেকারি মালিক ডালিম আহমেদ জানান, বেকারির স্থানটি বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ায় কিছুটা অপরিষ্কার। আলোর অভাব। তবে, ভবিষ্যতে বেকারির পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন বলে জানান।
বেকারির পণ্য কিনে ভোক্তভোগী তাহমিনা আক্তার বলেন, বেকারি থেকে বাচ্চাদের জন্য এক প্যাকেট কেক নিয়েছিলাম। বাসায় গিয়ে দেখি, বেশিরভাগ কেক নষ্ট ও পচা। বাচ্চারা বলছে দুর্গন্ধ। বেকারিতে কেকগুলো নিয়ে গেলে প্রথমে তারা পাল্টে দিতে চায়নি। কেকে উৎপাদন ও মেয়াদের কোনো তারিখ নেই।
এদিকে কালিন্দী ইউনিয়নের স্টার বেকারিতে প্রশাসন অভিযানের মাধ্যমে জরিমানা করে বন্ধও করেছিল। কিন্তু তারা গোপনে রাতের অন্ধকারে পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এই বেকারির মালিক পরিচয়ে মাহবুব আলম বলেন, 'সব ঠিকঠাক মতোই আছে।'
কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ভেজাল কেমিক্যাল ও নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি এসব খাবার খেলে পেট ব্যথা, চর্মরোগ, কিডনিতে সমস্যা, খাদ্যনালিতে সমস্যা, শরীর দুর্বলসহ জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের খাবার অবশ্যই আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকার সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, ভেজাল খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরপরও কোথাও অনিয়ম হলে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিট্রেট মোহাম্মদ ফয়সল বিন করিম জানান, বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো বেকারি পণ্য উৎপাদন বা বাজারজাত করতে পারবে না। এসব বেকারির বিরুদ্ধে দ্রম্নত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।