ক্যালেন্ডারে দিনটি বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি)। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৮টা ছুঁইছুঁই। নওগাঁর কুঞ্জবন মাস্টারপাড়া এলাকার একটি বাড়ি থেকে এক গৃহবধূর চিৎকার ভেসে আসছিল। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে আশপাশ থেকে লোকজন রীনা পারভীনের (৪৩) বাড়িতে যায়। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় শয়নকক্ষে তার হাত-পা বাঁধা মরদেহ। আলমারির তালা ভাঙা। ঘরের জিনিসপত্রও ছিল এলোমেলো। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মহাদেবপুর থানা পুলিশের ধারণা- নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করতেই পরিকল্পিতভাবে রীনাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার কথা তাৎক্ষণিকভাবে এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এমন দৃশ্যে হতভম্ব এলাকাবাসী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা।
শুধু এই হত্যাকান্ড নয়, সম্প্রতি দেশের সীমান্তবর্তী বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলা নওগাঁয় হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের জন্য হত্যাসহ নানা অপরাধ বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সর্বত্রই বজায় রয়েছে। অপরাধ কমিয়ে আনতে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনছেন তারা। মাদকের ব্যাপক বিস্তার, বেকারত্ব ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে এসব অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের দশকলোনী এলাকার মৃত লোকমান হোসেনের ছেলে ফেরদৌস আলমের স্ত্রী ও একই এলাকার মৃত ইয়াদ আলীর মেয়ে রীনা পাশের কুঞ্জবন মাস্টারপাড়ায় নিজ বাড়িতে তার ছোট ভাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। গত ২৫ জানুয়ারি রাতে নিহতের ছোট ভাই একরামুলের স্ত্রী বাড়ি এসে রীনার ঘরের দরজা বন্ধ দেখেন। ডাকাডাকি করেও না খুললে তারা দরজা ভেঙে ঘরের মেঝেতে হাত-পা বাঁধা রীনার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। পরে থানায় খবর দিলে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নওগাঁর মর্গে পাঠায় পুলিশ। এরপর নিহতের ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেন।
এদিকে গত ২০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে মহাদেবপুর-মাতাজিহাট সড়কের শেরপুর এলাকায় সড়কে দড়ি দিয়ে গতিরোধ করে রাইগাঁ ইউনিয়নের সহরাই গ্রামের বাসিন্দা সাগর রোহান নামে এক ব্যক্তিকে হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে তার মোটর সাইকেল ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। তবে এ ঘটনায় কোনো মামলা রেকর্ড করেনি মহাদেবপুর থানা পুলিশ।
এর আগে গত ১২ জানুয়ারি সকালে জেলার পত্নীতলা উপজেলার পত্নীতলা বাজার এলাকার নজিপুর-সাপাহার সড়কের পাশের জমি থেকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (অটো চার্জার) চালক আজিজার রহমানের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আজিজার মহাদেবপুর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের মৃত ছফের আলীর ছেলে। এ ব্যাপারে নিহতের জামাতা বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় মামলা করলে গত ২০ জানুয়ারি রাতে অভিযান চালিয়ে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার সাতগাড়া ও বগুড়ার সদর উপজেলার পীরগাছা এলাকা থেকে দু'জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ২৬ জানুয়ারি রাতে জেলার রানীনগর উপজেলার ভাটকৈ এলাকায় ফসলের মাঠে খামারিদের হাত-মুখ বেঁধে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অস্থায়ী খামার থেকে ডাকাতি হওয়া ৫০০টি হাঁস, ৬০০টি ডিম ও একটি মোবাইলফোন উদ্ধার করে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অন্যদিকে গত ১৪ জানুয়ারি ভোরে জেলার মান্দা উপজেলার দেলুয়াবাড়ি-চৌবাড়িয়া সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে প্রাইভেট কারসহ বেশ কয়েকটি যানবাহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্যরা গলায় ছুরি ধরে জিম্মি করে টাকা-পয়সা লুট করে নেয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মান্দা থানার ওসি মোজাম্মেল হক কাজী।
এসব ছাড়াও জেলাজুড়ে গভীর নলকূপের ট্রান্সফরমার চুরির হিড়িক চলছে। এতে কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। মিলছে না কোনো প্রতিকার।
রীনা হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মহাদেবপুর থানার ওসি (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ জানান, এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম চলছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে তারা তৎপর রয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করে নওগাঁর পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক জানান, জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই চমৎকার। অন্য জেলা এবং সাম্প্রতিক সময়ের ভেতরে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা সবচেয়ে ভালো।