থানচি সদর থেকে তিন্দু, রেমাক্রী ও বড় মদক এ একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ইঞ্জিনচালিত নৌকা। ঘর সমান বড় বড় পাথর, সরু নদীপথ আর তীব্র স্রোত উপেক্ষা করে গন্তব্যে যেতে হয় সেখানকার বাসিন্দাদের। বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছরই তিন্দু রাজা পাথরসহ বেশকিছু এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে ঘটে প্রাণহানির মতো ঘটনা।
অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় গর্ভবতীসহ রোগীদের নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে প্রতিবছর বিনাচিকিৎসায় মারা যায় অনেক মানুষ। এ ছাড়া কৃষকরা বিভিন্ন ফলদ ও ফলজ বাগান করলেও তা বাজারজাত করতে না পারায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিলেন তারা।
অবশেষে শত সমস্যা কাটিয়ে সাঙ্গু নদীর কোল ঘেঁষে তিন্দু হয়ে রেমাক্রী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সম্প্রতি এলজিইডির প্রকল্প পরিচালক, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্ভাব্য যাচাইয়ের জন্য পুরো এলাকা ঘুরে দেখেছেন এবং শিগগিরই ওই এলাকায় ব্রিজ কালভার্টসহ পাকা সড়ক নির্মাণ হবে আশ্বস্ত করেছেন। পাকা সড়ক নির্মাণ হলে তিন্দু ও রেমাক্রী ইউনিয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন, পাল্টে যাবে অর্থনীতির চিত্র। পর্যটন খাতেও খুলবে নতুন দুয়ার।
জানা যায়, থানচি উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে দুর্গম ও পশ্চাদপদ ইউনিয়ন তিন্দু ও রেমাক্রী। জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়নগুলোয় সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম চললেও দুর্গমতার কারণে মালামাল পরিবহণ করা ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। ফলে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই দুই ইউনিয়নে ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকান্ড। এ ছাড়া বিদু্যৎ ও মোবাইলের নেটওয়ার্ক-ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় আধুনিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এখানকার বাসিন্দারা। ফলে এখনো পিছিয়ে এ দুই ইউনিয়নের মানুষ। এ ছাড়া এখানে রয়েছে নাফাকুম, আমিয়াকুম, লাংলুক ঝর্ণা, রেমাক্রীকুমসহ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ওইসব পর্যটন কেন্দ্রে একমাত্র ভরসা করতে হয় ইঞ্জিনচালিত নৌকার ওপর। এদিকে নৌপথে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। একদিকে সরু নদীপথ ও তীব্র স্রোত, অন্যদিকে ঘর সমান বড় বড় পাথর রয়েছে এ পথে। পাথর ডিঙিয়ে ও তীব্র স্রোতে নৌকায় যাতায়াত করতে গিয়ে ঘটছে প্রাণহানিসহ নানা দুর্ঘটনা।
তিন্দু ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও কটেজ ব্যবসায়ী মংপ্রম্ন অং মারমা জানান, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক পর্যটক এখানে আসতে চায় না। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন হলে যে পরিমাণ পর্যটক এখানে আসে, এর কয়েকগুণ বাড়বে। এতে এখানকার ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিভাবে স্বাবলম্বী হবেন। এ ছাড়া কৃষকরাও তাদের জুমে উৎপাদিত ফসল সহজে বাজারজাত করতে পারবেন এবং নায্যমূল্য পাবেন।
রেমাক্রী ইউপি চেয়ারম্যান মুইশৈ থুই মারমা জানান, রেমাক্রী ইউনিয়নটি অতি দুর্গম হওয়ায় উন্নয়ন কাজ করতে অনেক অসুবিধা হয়। ইট, বালি, রড ও সিমেন্ট পরিবহণ খুব কঠিন। তাই এলাকায় পাকা ব্রিজ, কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে এখনো পিছিয়ে রয়েছি আমরা। এ ছাড়া সড়ক না থাকায় নদীপথে চলতে গিয়ে প্রতিবছর নৌকা দুর্ঘটনায় নিরাপত্তাকর্মীসহ অনেক সাধারণ মানুষ মারা যান।
তিনি আরও জানান, সড়ক না থাকায় মুমুর্ষু রোগীদের হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয় না। বিনাচিকিৎসায় মারা যান রোগী। এ ছাড়া কৃষিপণ্য পরিবহণ করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা।
উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইহ্লা মং মারমা জানান, সড়কের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে সাবেক পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি আশা দিয়েছিলেন। তারই প্রতিশ্রম্নতিতে সম্প্রতি এলজিইডির প্রকল্প পরিচালক, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সড়ক পাকা সড়ক নির্মাণে সম্ভাব্য যাচাই করে পুরো এলাকা ঘুরে দেখেছেন। শিগগিরই সাঙ্গু নদীর কোলঘেঁষে তিন্দু হয়ে রেমাক্রী পর্যন্ত পাকা সড়ক হবে আশ্বস্ত করে গেছেন। এখানে পাকা সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণ হলে তিন্দু ও রেমাক্রী ইউনিয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন ঘটবে। এলজিইডি'র সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী জামাল উদ্দিন জানান, তিন্দু থেকে রেমাক্রী পর্যন্ত পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য সম্প্রতি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আমরা এলাকাটি পরিদর্শন করেছি। এলাইনমেন্টের সুবিধার্থে আগে কাঁচা সড়কটি দৃশ্যমান করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে। মেঠো সড়কটি দৃশ্যমান হলে এলজিইডির পক্ষ থেকে এলাইনমেন্ট করবে। তারপর প্রকল্পটি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাবে।
এ বিষয়ে এলজিইডি'র বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী ডক্টর মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলাম মজুমদার বলেন, পর্যটন সম্ভাবনাময় এ ইউনিয়নগুলোতে পাকা সড়ক নাই এইটা কল্পনার বাইরে। এলজিইডির পক্ষ থেকে ডিম পাহাড় হয়ে তিন্দু পর্যন্ত সড়কটি পাকা করা হবে। পরে তিন্দু হয়ে রেমাক্রী পর্যন্ত সড়কটি সম্প্রসারণ করা হবে এবং রেমাক্রী বাজার সংলগ্ন আরও একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার কথা খেয়াল রেখে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হবে।