'ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ' প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ
পিপিআর বাস্তবায়ন নেই অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়নি অনুমোদনহীন নকশায় ভবন নির্মাণ
প্রকাশ | ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের নানা অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষে পর্যবেক্ষণ কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা ও অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না করেই প্রকল্পের কাজ বুঝে নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার নিমিত্তে নির্মিত ভবনগুলো ঠিকাদারদের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনের আলোকে নিয়োগকৃত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় মনিটরিং টিম (মনিটরিং কমিটি) ভৌত কাজের নিবিড় পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করার সুপারিশ করে। কিন্তু প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলাবস্থায় পরিবীক্ষণ করা হয়নি। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সভায় ছোটখাট ত্রম্নটি-বিচু্যতি সংশোধনের শর্তে ভবন নির্মাণের সব অনিয়মকে এক প্রকার বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, 'মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ' শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর একনেকের সভায় ৩৪৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বরাদ্দ পায়। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। পরবর্তী সময়ে আরডিপিপি সংশোধন করে তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পের আওতায় ৩৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ তলাবিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন, ১২ তলাবিশিষ্ট একাডেমিক-কাম রিসার্চ ভবন, ১২ তলার ভিতে ৬তলা পর্যন্ত শেখ রাসেল হল (৫৫০ ছাত্রের জন্য), ১০ তলাবিশিষ্ট শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল (৭০০ ছাত্রীর জন্য), ১০ তলা ভিতে পাঁচতলা পর্যন্ত সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মকর্তা কোয়ার্টার এবং পাঁচতলা পর্যন্ত মাল্টিপারপাস ভবন নির্মাণ করা হয়। গত বছরের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নবনির্মিত ওই ছয়টি ভবন উদ্বোধন করেন।
জানা যায়, টেন্ডার ডকুমেন্ট ও পিপিআর-২০০৮ সম্পূর্ণভাবে অমান্য করে ৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭২ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বহির্ভূতভাবে রাজস্ব বাজেট থেকে অগ্রিম দেওয়া হয়। বিষয়টি অডিট আপত্তিতে উঠে এলেও কোনো প্রতিকার হয়নি। ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০তলা প্রশাসনিক ভবন, ১২তলা একাডেমিক ভবন, মাল্টিপারপাস ভবনের নির্মাণ- এই তিন ভবনের কাজ করে নূরানি কনস্ট্রাকশন, আসবাবপত্র ক্রয়ের ঠিকাদারি পায় বনশিল্প করপোরেশন, দ্বিতীয় ছাত্রী হল এবং সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মকর্তা কোয়ার্টার ভবনের কাজ করে মেসার্স ভাউয়াল কনস্ট্রাকশন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের আওতায় ৫৫০ ছাত্রের জন্য নির্মিত ১২তলার ভিতে ৬তলা পর্যন্ত শেখ রাসেল হল নির্মাণ করা হয়। ওই হলের নির্মাণ সংক্রান্ত কাজ বুঝে নেওয়া এবং নকশা ও ডিজাইন অনুসারে কাজের মান যাচাই-বাছাইপূর্বক সঠিক হয়েছে কিনা এ সংক্রান্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ খাদেমুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কমিটি সরেজমিনে নির্মাণ কাজ পরিদর্শন এবং শেখ রাসেল হলে এ বিষয়ে একাধিক সভা করে। সর্বশেষ গত বছরের ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত সভায় কমিটি রিপোর্ট প্রদানে সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্ত কমিটি প্রদত্ত রিপোর্টে ৩০ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন করে কাজ বুঝে নেওয়ার কথা বলা হয়।
নির্মাণ কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য ম্যাটারিয়ালসের ল্যাব পরীক্ষার টেস্ট ইনটেনসিটি/পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি। নির্মাণ কাজের জন্য প্রাপ্ত কিছু ল্যাব পরীক্ষার টেস্ট রিপোর্ট কাগজপত্রে সন্তোষজনক বলা হলেও তা যথাসময়ে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়নি- যা তদন্ত কমিটির সুপারিশে জেরালোভাবে উলেস্নখ করা হয়েছে।
নির্মিত ভবনের দরজা-জানালার থিকনেস (বিওকিউ) অনুযায়ী প্রতিটিতে প্রায় আধা ইঞ্চি পরিমাণ কম রয়েছে। ফায়ার ফাইটিংয়ের হোস পাইপ ইনস্টলেশনের জন্য করা অনেক ছিদ্র বন্ধ করা হয়নি। ভবনের ফাউন্ডেশন, বিম, কলাম ও দেওয়ালের গাঁথুনির কাজ খালি চোখে বুঝা যায়নি বিধায় এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ভবনের নানা আইটেমের পরিমাপ যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিকারের সুপারিশ করা হয়। কমিটির যাচাই-বাছাই প্রতিবেদনে নানাবিধ ৩০টি অসঙ্গতির উলেস্নখ করে প্রতিকারের নিমিত্তে ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও- তা করা হয়নি।
সরকারের স্থানীয় সরকার বিধিমালা অনুযায়ী পৌর এলাকার অভ্যন্তরে সব সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা নির্মাণের আগে পৌরসভা কর্তৃক নকশা অনুমোদন গ্রহণ করার বিধান থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে টাঙ্গাইল পৌরসভার কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। টাঙ্গাইল পৌরসভা বিশ্ববিদ্যালয়কে নকশা অনুমোদনের বিষয়ে দু'বার নোটিশ পাঠালেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক শোনেননি।
নির্মাণকাজের অনুমোদনবিহীন নকশার কারণে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ প্রকল্পের মাল্টিপারপাস ভবনের ঢালাইকালে ক্যান্টিলিভার পোর্স ভেঙে ১৮ শ্রমিক আহত হন। ওই সময় ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নামেমাত্র তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় ঢালাইয়ের ত্রম্নটির কারণে সমস্যা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী ভবনের ডিজাইনের পরিবর্তন করে ক্যান্টিলিভার স্স্নাবের একটি কলাম সাপোর্ট দেয়।
এ ঘটনায় ভবনের ডিজাইনগত ত্রম্নটি রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। প্রজেক্ট ইমপিস্নমেন্টেশন কমিটি (পিআইসি) সভার সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে প্রকল্প সঠিকভাবে নির্মাণে প্রকল্প পরিচালককে নির্দেশ দেন। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মোস্তফা কামাল ২০১৯ সালের ২৪ জুন এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলীকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল হলের নির্মাণ সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ খাদেমুল ইসলাম জানান, তাদের সাত সদস্যের কমিটির সবাই একমত হয়ে ৩০ দফা সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন সিলগালা করে জমা দিয়েছেন। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশদ বলতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য প্রফেসর ড. ফরহাদ হোসেন জানান, ছোটখাট ত্রম্নটি-বিচু্যতি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ দায়িত্বে করে দেবে মর্মে ভবনগুলো বুঝে নেওয়া হয়েছে। গত সপ্তায় রিজেন্ট বোর্ডের সভায় প্রকল্পের ভবনগুলো বুঝে নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ও পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. ফেরদৌস জামান জানান, প্রকল্পটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া এ বিষয়ে তিনি বেশি কিছু জানেন না।