দুর্নীতিতে ডুবন্ত ও লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হওয়া বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কর্তৃক পরিচালিত জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালকে দুর্নীতিমুক্ত করে এক বছরের ব্যবধানে ৪ কোটি টাকা বাড়তি আয় করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় এবং সিজার ডেলিভারি ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় সম্পন্ন করা হচ্ছে। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট চত্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন জেলা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান, জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা দিদারুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম চৌধুরী পরাগ, নির্বাহী সদস্য রাইসুল ইসলাম চৌধুরী এমিল, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপস্নব, শহীদুল ইসলাম পিন্টু, সুগ্রীব মজুমদার দোলন, ইসমাইল হক চৌধুরী ফয়সাল, শাহাদাত হোসেন চৌধুরী রুমেল, চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. রোজী দত্ত, ইউএলও আবদুল মান্নান, প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দৌলা সুজন, চেয়ারম্যানের সহকারী একান্ত সচিব রিয়াজুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে রেড ক্রিসেন্ট চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, 'বর্তমান নির্বাহী পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করে আয় গত বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১১ কোটি টাকায় উন্নীত করেছি, যা গত বছর ছিল সাত কোটি টাকা। বর্তমান পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত এক বছরে বহু সংস্কার কাজ করার পরও আমরা গত বছরের তুলনায় অতিরিক্ত ৪ কোটি টাকা বেশি আয় করেছি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনগণের কাছে হাসপাতালের আগের ইমেজ ফিরিয়ে এনে রোগীর সংখ্যা বর্তমান বছরে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। আগামী এক বছরে আমরা বর্তমান আয়ের সঙ্গে আরও ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা বেশি আয় করার টার্গেট নির্ধারণ করেছি। বর্তমানে হাসপাতালটি শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত হওয়ায় আগামী বছর ১৫ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করছি। আর এসব অসম্ভব কাজগুলো সম্ভব হয়েছে আগের লুটপাট বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে পারার কারণে। সনদ জালিয়তি করে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ও অন্যান্য অনিয়মে যুক্ত ৮ জন কর্মচারীকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদনের আলোকে ইউনিট কার্যনির্বাহী পর্ষদ কর্তৃক চাকরিচু্যত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।'
লিখিত বক্তব্যে চেয়ারম্যান আরও জানান, ২০২৩ সালে হাসপাতালে প্রতি মাসে ৫৫ লাখ টাকা আয় হলেও বর্তমান কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই আয় মাসে এখন ১ কোটি ৮ লাখ টাকায় উন্নীত করেছি। এক বছর আগে দায়িত্ব নেওয়ার সময় হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৮ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া ছিল। আগের কমিটির সেই ৮ মাসের বকেয়া থেকে ইতোমধ্যে নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের পাশাপাশি বকেয়া ৭ মাসের বেতন পরিশোধ করেছি। এখন প্রভিডেন্ট ফান্ড সঠিকভাবে জমা হচ্ছে। যারা অবসরে যাচ্ছেন তাদের পাওনা যথাযথভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে, যা অতীতে ফান্ড সংকটের কারণে করা হতো না। বর্তমান নির্বাহী পর্ষদ সদস্যরা কোনো ধরনের সম্মানী গ্রহণ করছেন না। রেড রিক্রেন্ট থেকে চেয়ারম্যানের জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ রয়েছে। আমার নামে বরাদ্দ থাকা গাড়িটি নিজে ব্যবহার না করে হাসপাতালের ডাক্তারদের আনা-নেওয়াসহ হাসপাতালের প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। গাড়ির নামে অপচয় রোধ করে বিগত ২০২৩ সালে প্রায় ১৫ লক্ষাধিক টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। নবজাতকদের চিকিৎসায় একটা অত্যাধুনিক এনআইসিইউ বিভাগ চালু করে এতে ফটোথেরাপি, বেবী ওয়ার্মার মেশিন নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে। আল্ট্রাসনোগ্রাফী বিভাগের জন্য প্রায় ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক ৪ডি কালার আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন সংযোজন করা হয়েছে। প্যাথলজি বিভাগের উন্নতিকরণে অত্যাধুনিক অলিম্পাস মাইক্রোস্কোপ সংযোজন করা হয়েছে। জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং ইনস্টিটিউটকে নার্সিং কলেজে উন্নীতকরণের জন্য প্রায় ৩,৬০০ বর্গফুটের শিক্ষার্থীদের জন্য 'নার্সিং ল্যাব' নির্মাণ করা হয়েছে। হাসপাতালের ভেতর পস্নাস্টিক পেইন্ট ও বাইরে ওয়েদার কোট রঙের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা দায়িত্ব নেওয়া সময় হাসপাতাল ভবন অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী ছিল, যেমন- ইনডোর রোগীদের কেবিন-বেডগুলো নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর ছিল, বাথরুম, কমোড অপরিচ্ছন্ন ও করিডোরগুলো ব্যবহার অনুপযোগী ছিল, দরজা-জানালায় পর্দা ছিল না, বেড শিটগুলো অস্বাস্থ্যকর, নোংরা ছিল, দেয়ালে শ্যাওলা পড়া ও আস্তর খসে পড়তে ছিল, ওটি রুম, লেবার রুম প্রায় ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল, সেইফটি ট্যাংক, ওয়াটার রিজার্ভার গত ২০ বছরেও পরিষ্কার করা হয়নি, যা ইতোমধ্যে পরিষ্কার করা হয়েছে, হাসপাতালে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অদক্ষ জনবল বিদ্যমান ছিল, অনেক ডাক্তার কর্মস্থলে নিয়মিত উপস্থিত থাকত না এবং নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হতেন না ও সময়ের পূর্বে কর্মস্থল ত্যাগ করতেন। কেউ কেউ অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করতেন। এসব অব্যবস্থাপনা কঠোরভাবে বন্ধ করা হয়েছে। জেনারেটরের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত জ্বালানি তেলের নামে নিকট অতীতে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, তেল ব্যবহারে কোনো লগ বই ছিল না। বিদু্যৎ বিল অনেক বেশি ছিল। হাসপাতালের ২টি মাইক্রো ও একটি অ্যাম্বুলেন্সের জ্বালানি ও মেরামতের নামে বছরে বিপুল পরিমাণের অর্থ অপচয় করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের কোনো লগ বই ব্যবহার করা হতো না। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর লগ বই ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অতীতে প্রতিদিন ২০০ লিটার তেল খরচ করা হতো, যা এখন ৫ লিটারে নেমে এসেছে। চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট জন্মের পর কোনো দিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। আমি দায়িত্ব নিয়ে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘনভাবে রেড ক্রিসেন্ট জেলা নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন করেছি। এ নির্বাচনে রেড ক্রিসেন্টের ২,৯৪৬ জন আজীবন সদস্য ও ৪৩৪ জন বার্ষিক সদস্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দঘন পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। উলেস্নখ্য, উক্ত নির্বাচনের দিন আগত ভোটার ও মেহমানদের জন্য মেজবানির আয়োজন করা হয়। জেলা ইউনিটের সব প্রজেক্টে (হাসপাতালসহ) সব ক্যাশ লেনদেন বন্ধ করে চেকের মাধ্যমে সম্পাদন করা হচ্ছে। হাসপাতালের রোগীদের স্বার্থ বিবেচনায় আরও একটি ফার্মেসি স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দৈনিক হাসপাতালের রোগী সেবার বিবরণ ও আয় ব্যয়ের রিপোর্টের প্রচলন করা হয়েছে। ১২টি কেবিনকে এসি, ফ্রিজ, টিভি ও উন্নতমানের আসবাবপত্রে সজ্জিত করে ডিলাক্স কেবিনে উন্নীত করা হয়েছে। হাসপাতালের নীচ তলার ৭টা কেবিনকে উন্নত করা ও একটি ভিভিআইপি কেবিন তৈরি করা হচ্ছে। জাতীয় ও অন্যান্য দিবসসমূহ যথাযথ মর্যাদায় হাসপাতাল অভ্যন্তরে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেমন- ২১ ফেব্রম্নয়ারি, শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন, ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস ২০২৩ উদযাপন, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস-২০২৩ উদযাপন, ৮ মে বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস উদযাপন ১২ মে নার্সেস দিবস উদযাপন ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উদযাপন যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে মাহে রমজানে ইফতার ও দোয়া মাহফিল ২০২৩ অনুষ্ঠান ৭ম বিভাগীয় যুব ক্যাম্প সম্পন্ন করা হয়। এতে ১ কোটি ৭ লাখ টাকার বাজেটের যুব ক্যাম্প পরিকল্পিতভাবে খরচ করে মাত্র ৪১ লাখ টাকায় সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। উপজেলা যুব সম্মেলন- ১মবারের ফটিকছড়িতে উপজেলা যুব সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে ফটিকছড়ির প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২০০০ জন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অতিথি অংশগ্রহণ করেন। ভবিষ্যতে প্রতিটি উপজেলায় এ সম্মেলন আয়োজন করা হবে, দুর্যোগ মোকাবিলা ও দুর্যোগ-পরবর্তী কার্যক্রম- (অ) ঘূর্ণিঝড় মোখা (ই) হামুন (ঈ) মিধিলি প্রতিরোধে যুব রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবিলা ও দুর্যোগ-পরবর্তী কার্যক্রমে সহায়তা করছি। দুর্যোগের পরে এবং আগে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমিটি গঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম ত্বরান্বিত করেছি। সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি কিছু স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তুলে ধরেন। জেমিসন হাসপাতালে (১) ডায়াগনস্টিক বিভাগকে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করে আরও আধুনিকায়ন করা, (২) রেড ক্রিসেন্ট আই কর্নার নামে একটি নতুন চক্ষুসেবা ইউনিট চালু করা, (৩) কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস সেন্টার নতুনভাবে স্থাপন করা (৪) থ্যালামেসিয়া সেন্টারকে ১০ শয্যা থেকে ২০ শয্যায় সম্প্রসারণ করা, যার কাজ ইতোমধ্যে প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে, (৫) ১৮ তলাবিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মাণ করার পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি, (৬) জঙ্গল ছলিমপুরে ৫ একর খাস জমি চাওয়া হয়েছে। সেই জমি পাওয়া সাপেক্ষে রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
গত এক বছরে জাতীয় সদর দপ্তরের সহযোগিতায় জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিট চট্টগ্রাম জেলার বিবিন্নন উপজেলায় ৩,৩০০ পরিবারকে ৬ হাজার টাকা করে দুই কোটি টাকা বিতরণ করেছেন। ২,৫০০ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেন, ১,৭০০ পরিবারকে গৃহস্থালি পণ্য বিতরণ করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি