'কেমিক্যাল বা কোনো রাসায়নিক সার না দিয়া আমরা বিষমুক্ত সবজি ফলাইছি। এই সবজি নিজেরা পরিবার-পরিজন লইয়া খাই আর বাজারে বিক্রি করি। আমগ সবজি খাইলে মানুষ মরব না, বছরের পর বছর বাঁইচ্যা থাকব।'
কথাগুলো বলছিলেন রাজধানী ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার কলাতিয়া এলাকার মোবারক হোসেন। শুধু তিনি নন। তার মতো উপজেলার অনেক কৃষক কেমিক্যালযুক্ত সারের পরিবর্তে বিষমুক্ত বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেছেন। ফলনও পেয়েছেন অনেক। ইতোমধ্যে তাদের চাষ করা ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মুলা, গাজরসহ বেশ কিছু শীতের আগাম সবজি বাজারে উঠেছে। এ বছর সবজি চাষে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়ায় লাভের মুখ দেখেছেন রাজধানী ঢাকার কেরানীগঞ্জের কৃষকরা। এতে খুশির জোয়ার বইছে চাষিদের মধ্যে। কেরানীগঞ্জে বেশি লাভের আশায় শীতকালীন সবজির আগাম চাষ বাড়ছে। শুধু নিজেদের চাহিদার জন্যই নয়, বাণিজ্যিকভাবেও চাষ হচ্ছে এসব সবজি।
কৃষকরা জানান, যে কোনো ফসল আগাম চাষ হলে বাজারে চাহিদা বেশি থাকে। মুনাফাও বেশি হয়। এ বছর উঁচু জমিতে সবজি চাষে ঝুঁকছেন তারা। কম সময়ে কম খরচে বেশি মুনাফার জন্য ফুলকপি ও বাঁধাকপির জুড়ি নেই। এবার শীত মৌসুমে ৩২শ' হেক্টর জমির বিপরীতে প্রায় হেক্টর প্রতি ২৪ মেট্রিক টন মেট্রিক টন শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে উপজেলা কৃষি অফিস।
মাঠ ঘুরে দেখা যায়, হজরতপুর ইউনিয়নের কানারচর, কদমতলী, আলিপুর, লংকারচর, ছয়ঘড়িয়াকান্দি, রসুলপুর, ঢালিকান্দি, মানিকনগর, রাধাকান্তপুর, জগন্নাথপুর, মধুরচর ও কোন্ডা ইউনিয়নের আইন্তা পূর্ব, মির্জাপুর, মনুরবাগ, ব্রাহ্মণগাঁও, কাজিরগাঁও, জাজিরা, নতুন বাক্তার চর ও রোহিতপুর, কলাতিয়া, তারানগর, তেঘরিয়া ও বাস্তা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার কয়েক লক্ষাধিক কৃষক শীতের সবজি চাষ করেছেন। নতুন কিছু চারা রোপণ, পরিচর্যা, সবজি তুলে বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। মৌসুমে সবজি বিক্রি করে জমির খাজনা, পূর্বের ধার পরিশোধের পাশাপাশি পুরো বছরের সঞ্চয় করে নেবেন অনেকে। তাই এখন বসে থাকার সময় নেই। এই শীত মৌসুমেই একই জমিতে কয়েকবার সবজির চাষাবাদ করবেন তারা। এর মধ্যে সাথী ফসল হিসেবে ধনে পাতার সঙ্গে ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচা মরিচ ও বেগুন চাষ করছেন। এদিকে বিষমুক্ত সবজি চাষে হযরতপুর ইউনিয়ন ইতোমধ্যে রোল মডেল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে বলে জানা গেছে।
হযরতপুর ইউনিয়নের সবজি চাষি মোহন মিয়া বলেন, দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষ করেছেন। এতে বিঘাপ্রতি হাল চাষ, চারা উৎপাদন, সার, সেচ, নিড়ানি ও পরিবহণ খরচ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। আর বিঘাপ্রতি কপির ফলন হবে প্রায় ৬০-৬৫ মণ। এখন প্রতি মণ কপি বাজারে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬০০ টাকা দরে। এতে খরচ বাদে কপি বিক্রি করে প্রায় ৯৪ হাজার টাকা লাভ হবে বলে জানান তিনি।
একই এলাকার কপি চাষি জসিম উদ্দিন জানান, এবার এক বিঘা জমিতে ফুলকপির চাষ করেছেন। সেখানে তিন হাজার কপি রয়েছে। গড়ে প্রতি পিস কপি এক কেজি হিসেবে ফলন হবে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ মণ। ৪০ টাকা কেজি হিসেবে এতে তার খরচ বাদে লাভ হবে প্রায় ৯০ হাজার টাকা।
মানিকনগর গ্রামের কৃষক দিদারুল আলম বলেন, বর্তমানে তার জমিতে উৎপাদিত বেগুন বিক্রি করছেন ৪০ টাকা কেজি পাইকারি দরে। খুচরা বাজারে এই বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। একইভাবে ঢেঁড়শ বিক্রি করছেন ৩৫ টাকা কেজি দরে। খুচরা বাজারে ব্যবসায়ীরা ঢেঁড়শ বিক্রি করছেন ৫০-৬০ টাকা কেজি। মুলাটালী জাতের সিম বিক্রি করছেন ৬০ টাকা দরে, যা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ বাজারে প্রতিটি সবজিই ৫-১০ টাকা লাভে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
কোন্ডা ইউনিয়ন মোলস্না বাজার গ্রামের কৃষক নুরে আলম বলেন, বিষমুক্তভাবে এসব শাকসবজি চাষ করায় চাহিদা বাড়ছে দিনদিন। সুনাম ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ এখানকার মাটি উর্বর হওয়ায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিতে হয় না। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি জৈব সার জমিতে দেন তারা। এজন্য শাকসবজি খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনই দামও কিছুটা বেশি।
কলাতিয়া বাজারে শিম বিক্রি করতে আসা কৃষক রাকিবুল ইসলামের বলেন, এ বছর এক বিঘা জমিতে শিম চাষ করেছেন। ভালো ফলন হয়েছে। বাজারে মোটামুটি দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। জমি থেকে শিম তুলে বিক্রি করতে শুরু করেছেন। দাম এমন থাকলে লাভ ভালোই হবে।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পরিবেশবান্ধব নিরাপদ ফসল উৎপাদনের আওতায় উপজেলায় হযরতপুর ও কলাতিয়া ইউনিয়ন বিভিন্ন গ্রামে মডেল সবজি উৎপাদনে কার্যক্রম শুরু করেছন তারা। এ বছর থেকে হযরতপুর ও কলাতিয়া এলাকায় পাঁচ শতাধিক কৃষক নিরাপদ সবজি উৎপাদন করছেন। এখানে পরিবেশবান্ধব যত ধরনের প্রযুক্তি রয়েছে, সেসব ব্যবহার করে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে।
কিষানী ফরিদা বেগম বলেন, 'এ বছর থেকে আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে জৈব সার ব্যবহার করে শিম ও লালশাক বুনেছি। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে আমরা দ্বিগুণ ফলন পেয়েছি। রাসায়নিক বা বিষমুক্ত হওয়ায় ফসলের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। ওই এলাকায় উৎপাদিত সবজি ঢাকার মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার ও হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকায় নিয়ে বিক্রি করা হয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহুয়া শারমিন মুনমুন জানান, আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কেরানীগঞ্জ কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শতাধিক জনের বাড়ির আঙিনায় সবজি বাগান করে দেওয়া হয়েছে। এতে আমরা বিনামূল্যে বাঁশ, খুঁটি, বীজ, সার দিচ্ছি। পাশাপাশি কৃষি অফিসাররা নিয়মিত বাগান পরিদর্শন করেন ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি আরও জানান, এবারের আবহাওয়াটা চমৎকার। ফলে আশা করছি, উৎপাদন ভালো হবে। লাভবান হবেন চাষিরা।