দিগন্ত জোড়া মাঠে সরিষার আবাদ। বাতাসে ভাসছে মিষ্টি গন্ধ। ফুলের সঙ্গে মৌমাছির প্রেম। গত কয়েকদিন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, বীরগঞ্জ, কাহারোলসহ সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে এ অপরূপ দৃশ্য দেখা গেছে।
সরিষা চাষে পরিশ্রম ও ব্যয় কম। অধিক লাভজনক হওয়ায় দিনাজপুরের মানুষ দিন দিন ঝুঁকছে শরিষার আবাদে। গত তিন বছরে প্রায় ৪৮ শতাংশ জমিতে শরিষার আবাদ বেড়েছে। সেইসঙ্গে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে জেলার ১৩টি উপজেলায় সরিষা আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ১৬২ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন ছিল ১৭ হাজার ৭৬৯ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে আবাদ হয়েছে ১৬ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন ছিল ২৩ হাজার ৫৬৪ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদ হয়েছে ২২ হাজার ৭৪০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন ছিল ২৯ হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন।
চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদ হয়েছে ২৭ হাজার ১৯৭ মেট্রিক টন। সেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। তবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের।
জেলার সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৭১২ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে বীরগঞ্জ উপজেলায়। এছাড়াও হাকিমপুর, বোচাগঞ্জ, চিরিরবন্দর, খানসামা, কাহারোল, বিরল ও সদর উপজেলায় তুলনামূলক শরিষার আবাদ বেশি হয়েছে। এ জেলায় বারি সরিষা- ১৪, ১৭, ১৮ ও বিনা সরিষা-৯, ১১ জাতের চাষ বেশি হয়েছে।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকার কৃষক পরেশ চন্দ্র রায় জানান, এবার দুই একর জমিতে বিনা-১১ জাতের শরিষা চাষ করেছেন। তাতে কাটামাড়াই পর্যন্ত খরচ পড়বে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। সাধারণত ৮৫ থেকে ৯০ দিন পরে ফসল তোলা হয়। আশা করছেন বিঘা প্রতি ৯ মণ সরিষা পাবেন।
বীরগঞ্জ উপজেলার দেবীপুর গ্রামের কৃষক শহিদুল আলম এবার তিন একর জমিতে বারি সরিষা-১৪ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, 'সরিষা চাষে পরিশ্রম কম। আলুতে যেমন ?উৎপাদনের, দাম পাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সরিষাতে সেই ঝুঁকি নেই। এজন্য আমন ধান কাটার পরে আলু বাদ দিয়ে সরিষা লাগিয়েছি। তবে শুকিয়ে বিক্রি করতে পারলে তিন হাজার টাকার ওপরে প্রতি মণের দাম পাওয়া যায়।'
চিরিরবন্দর উপজেলার অমরপুর এলাকার সরিষা চাষি অমল চন্দ্র রায় বলেন, অপেক্ষাকৃত নিচু রস ধরে রাখে এমন মাটিতে সরিষার আবাদ ভালো হয়। এবার তিনি ৪ বিঘা জমিতে বারি-১৫ জাতের সরিষা লাগিয়েছেন। অন্যান্য সময়ে ওই জমিগুলোতে আলু লাগাতেন।
কৃষি বিভাগ জানান, সাম্প্রতিককালে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় কৃষি বিভাগ 'তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি' ও 'কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল-তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন সংরক্ষণ ও বিতরণ' দু'টি প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। প্রকল্পের আওতায় চলতি মৌসুমে জেলার ৫২ হাজার কৃষকের প্রত্যেককে প্রণোদনা হিসেবে এক কেজি করে শরিষার বীজ, ১০ কেজি ড্যাব ও ১০ কেজি পটাশ সার সরবরাহ করা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুজ্জামান বলেন, দিনাজপুরে কয়েক বছর ধরে সরিষার আবাদ বাড়ছে। ভোজ্যতেল উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। কৃষক পর্যায়ে উদ্বুদ্ধকরণ সমাবেশ, গবেষণা, সেমিনার করা হয়েছে। এছাড়াও জেলায় ৮৫টি এসএমই সংগঠন করা হয়েছে। যারা বেশি পরিমাণে সরিষা উৎপাদন করে থাকেন, কৃষি বিভাগ তাদের উৎপাদিত শরিষা বীজ বাজারজাতকরণে মোড়ক, ওজন মেশিনসহ প্যাকেজিংয়ের যাবতীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করছে। তিনি আরও বলেন, এবার উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ এবার উচ্চ ফলনশীল জাত রাবি-১৮ জাতের সরিষা বেশি চাষ হয়েছে।