পৌষের শেষদিক থেকে হঠাৎ করেই বেড়েছে শৈত্যপ্রবাহ ও ঘনকুয়াশা এবং কনকনে ঠান্ডা বাতাসের দাপট। মাঘের শুরু থেকেও ঘনকুয়াশা ও হাঁড় কাঁপানো শীত পড়তে শুরু করেছে। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় বোরো বীজতলাসহ জমির উঠতি ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। তীব্র শীতে বীজতলা ও ধান গাছের চারা হলুদ বর্ণ হয়ে দুর্বল হওয়াসহ ক্ষতির শঙ্কা করছেন তারা। এদিকে তীব্র শীত উপেক্ষা করে বীজতলা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলায় সাতদিনের মাথায় একটু সূর্যের দেখা মিললেও কুয়াশা ও তীব্র শীতের কবলে পড়ছে বোরো বীজতলা। এ কারণে বীজতলার চারার গোড়া, পাতা পচা রোগ ও চারা হলুদ বর্ণ হয়ে দুর্বল হওয়াসহ ক্ষতির শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এই উপজেলার কৃষকরা।
জানা গেছে, উপজেলায় ১৯ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য ৯৭৫ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। কয়েক দিন আগেই তৈরি বীজতলায় চারাগুলো বেড়ে উঠছিল। এর মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে শীতের পাশাপাশি দিনভর ঝরছে কুয়াশা। এতে বীজতলায় বেড়ে ওঠা চারাগুলো সবুজ থেকে লালচে আবরণ ধারণ করছে। যা পরে শুকিয়ে মারা যাবে। তবে এগুলোর হাত থেকে বীজতলা রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষক। কারণ বীজতলা রক্ষা করতে না পারলে ইরি-বোরো চাষ হুমকির মুখে পড়বে। তাতে তাদের কপাল পুড়বে। আর বোরো চাষ নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা-মাঠকর্মীরা।
উপজেলার রিধইল গ্রামের কৃষক মাসুদ রানা, নাজমুল হোসেন জানান, তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে বীজতলার চারাগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছে। চারা রক্ষায় কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী বালাইনাশক প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে উৎপাদনে অতিরিক্ত খরচও হচ্ছে। চারা রক্ষা করতে না পারলে বোরো চাষ অনিশ্চিত।
নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার গাজিউল হক বলেন, শীত ও কুয়াশার হাত থেকে বীজতলার চারা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীরা। চাষ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষিবিভাগ কৃষকের ঘরে ফসল ওঠা পর্যন্ত সহযোগিতা করবে। এখন পর্যন্ত কোনো বীজতলার ক্ষতি হয়নি।
মোহনগঞ্জ (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, হাওড়পাড়ের কৃষিনির্ভর মোহনগঞ্জ উপজেলায় অতি ঠান্ডার কারণে কৃষিতে রোগে হানা দিয়েছে। এতে ফসলের লক্ষ্যমাত্রা কমে যাবে বলে ধারণা করছে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কৃষকদের সর্বনাশ ডেকে আনছে এই ঠান্ডা এমন অভিযোগ তাদের।
নাগডরা গ্রামের কৃষক বকুল জানান, ১২০ শতক জমিতে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপির চাষ করে এখন বিপাকে পড়েছেন। অতিরিক্ত ঠান্ডায় ফসলে ছত্রাকজনিত রোগ দেখা দিয়েছে। ধানের বীজতলায় চারা রোগা হয়েছে। উপজেলায় সর্বত্র একই অবস্থা, এতে কৃষক দিশেহারা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস শাকুর সাকী জানান, অতি ঠান্ডায় শাকসবজি ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এতে আলুসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন কমে যাবে। বীজতলায় প্রতিদিন পানি দিয়ে পানি রাতে ধরে রাখতে হবে, সকালে পানি বদলাতে হবে। অন্যথায় ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে বীজতলা অক্রান্ত হতে পারে।
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলায় মাঘ মাসের শুরুতেই ঘনকুয়াশা, হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীত উপক্ষো করে ইরি-বোরো ধান চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। স্থানীয় কৃষাণ-কৃষাণিরা নিজেদের খাবার জোগাড় করতে ধান চাষের জন্য মাঠে নেমেছেন। মাঠের পর মাঠজুড়ে কেউ চারা তুলছেন, কেউ জমি তৈরির কাজ করছেন আবার কেউবা ক্ষেতে পানি সেচের জন্য শ্যালো মেশিনে সেচ দিচ্ছেন। এ নিয়ে বুধবার উপজেলার বিভিন্ন এলাকাসহ সীমান্তবর্তী আদিবাসী এলাকাগুলোতে গিয়ে এমনটাই দেখা গেছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন জাতের ইরি-বোরা ধানচাষের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৮ হাজার ৬শ' হেক্টর। শীতের তীব্রতার কারণে এ পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার হেক্টরের মতো রোপণ হয়েছে। উপজেলার কুলস্নাগড়া, দুর্গাপুর, গাওকান্দিয়া, চন্ডীগড়, বাকলজোড়া ও কাকৈরগড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ধুম পড়েছে বোরো আবাদের। স্থানীয় জাতের বীজের চেয়ে হাইব্রিড এবং উচ্চ ফলনশীল উফশী ধান আবাদে আগ্রহ প্রকাশ করছেন এলাকার কৃষক।
গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের কৃষক এইচএম সাইদুল ইসলাম বলেন, আগাম বন্যা হওয়ার আশঙ্কায় এবার আগেভাগেই ধানের ক্ষেত তৈরি করে চারা রোপণ শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত সার, কীটনাশক ও ডিজেলের সমস্যায় পড়তে হয়নি। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা তাদের এলাকায় বোরো আবাদ ভালো করার জন্য সব সময়ই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসার নিপা বিশ্বাস বলেন, এবার শৈত্যপ্রবাহ, ঘনকুয়াশা ও হাঁড় কাঁপানো শীতের মধ্যেও বীজতলার কোনো ক্ষতি হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ইরি বোরো চারা রোপণের লক্ষ্যমাত্রা শেষ করা যাবে।
দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) প্রতিনিধি জানান, অতিরিক্ত ঠান্ডায় জনজীবনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা শীতে কাঁপছে চুয়াডাঙ্গাবাসী। এ শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করেই ইরি-বোরো রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষাণ-কৃষাণিরা। ধান রোপণ নিয়ে গ্রামে গ্রামে চলছে এখন উৎসবের আমেজ।
সরেজমিন দেখা গেছে, কেউ জমিতে হালচাষ দিচ্ছেন, কেউ বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলছেন, আবার কেউ জমিতে চারা রোপণের উপযোগী করে তোলায় ব্যস্ত রয়েছেন। এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে দামুড়হুদার বিভিন্ন মাঠজুড়ে। চলিত মৌসুমে কৃষক ধানের দাম ভালো পাওয়ায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি বিভাগ মনে করছে।
দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ৯ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে উপজেলায় চলছে বোরো আবাদের মৌসুম। আর বোরো আবাদের কারণে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। কুয়াশা ঢাকা শীতের সকাল হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে কৃষকরা বোরো ধানের চারা রোপণের ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে ধানের কচি চারার সবুজ গালিচা, কোথাও গভীর নলকূপ থেকে চলছে পানিসেচ, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার দিয়ে চলছে জমি চাষের কাজ, গরু মহিষ দিয়ে চলছে মাঠ সমান করার কাজ।
দামুড়হুদা কুড়লগাছী এলাকার ধান চাষি জালাল উদ্দীন বলেন, তেলের দাম বাড়ায় পাওয়ার টিলার মেশিন দিয়ে হালচাষের খরচ বাড়ছে। কৃষি কাজই তাদের পেশা। কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনছেন, তবু আশায় বুক বেঁধে বোরো আবাদ করছেন।
উপজেলার ধান্যঘরা গ্রামের কৃষক ইউসুফ আলী জানান, কৃষিতে উৎপাদন খরচ দিন দিন যেভাবে বাড়ছে সে তুলনায় ধানের দাম বাড়ছে না। বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হন জমি বর্গা নিয়ে আবাদ করেন যেসব কৃষক। সরকারকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় এবং দাম বাড়ানোর জন্য দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।
দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি অফিসার শারমিন সুলতানা বলেন, কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিসহ সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বাজারে ইউরিয়া, ফসফেট, টিএসপি, পটাশসহ সব ধরনের সার ও তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় ইরি-বোরোর ভরা মৌসুমেও সংকট থাকবে না। এ ছাড়া কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
শার্শা (যশোর) প্রতিনিধি জানান, যশোরের শার্শায় চলতি মৌসুমে ইরি-বোরো আবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। প্রচন্ড শীত আর ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে ফসল ফলানোর চেষ্টা করছেন তারা। এর আগে ধানের দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে কিছুটা উচ্ছ্বাস রয়েছে। এদিকে মাঘ মাস পড়ার আগে থেকেই শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। ফলে ঘন কুয়াশা আর কনকনে শীতের মধ্যে কৃষকরা ইরি-বোরো ধান চাষাবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, তীব্র শীত উপেক্ষা করে কোথাও বীজতলা তৈরি, কোথাও বীজতলা থেকে চারা তুলছে। আবার কেউ জমি তৈরি ইরি-বোরো ধানের চারা রোপণ করছেন কৃষকরা। গভীর ও অগভীর নলকূপ দিয়ে পুরোদমে চলছে জমিতে সেচকাজ।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে ইরি-বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৩৫০ হেক্টর। গত বছরেও একই পরিমাণ জমিতে ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
কৃষক মোস্তাক আহমেদ বলেন, চলতি বছরে ৩ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করার জন্য জমি প্রস্তুত করেছেন। এখন বীজতলা থেকে চারা উত্তোলন করে রোপণের চেষ্টা চলছে। শীত ও ঘন কুয়াশায় কাজে কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।
শার্শা উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ দীপক কুমার সাহা বলেন, বোরো ধান রোপণ কিছুদিনের মধ্যে শেষ হবে। আবহাওয়াজনিত কারণে প্রতিবছর বীজতলা কম-বেশি নষ্ট হলেও এ বছর শীত ও ঘন কুয়াশার মধ্যেও বীজতলায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। চলতি মৌসুমে কৃষকরা যেন তাদের সোনালি স্বপ্নকে ঘরে তুলতে পারেন সেজন্য সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।