মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা

পৌষের তীব্র ঠান্ডায় বিপর্যস্ত জনজীবন

স্বদেশ ডেস্ক
  ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন সাধারণ মানুষ -যাযাদি

দেশের উত্তরাঞ্চলে টানা শৈতপ্রবাহ এবং পৌষের তীব্র ঠান্ডায় মানুষসহ প্রাণিকুল কাতর হয়ে পড়ছে। ঘন কুয়াশা, হিমেল হাওয়া আর কনকনে ঠান্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সবচেয়ে বেশি কষ্টে রয়েছে ছিন্নমূল মানুষ। এদিকে তীব্র-শীত আর ঘন কুয়াশায়ও থেমে নেই হাওড়াঞ্চলের কৃষকদের চাষাবাদ। শীত ও ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে তারা জমিতে ফসল ফলানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলের ভারত সীমান্ত ঘেঁষা জেলা কুড়িগ্রামে পৌষের তীব্র ঠান্ডা বিরাজ করছে। ঠান্ডার তীব্রতায় এখানকার মানুষসহ প্রাণিকুল কাতর হয়ে পড়ছে। ছিন্নমূল মানুষ মোটা/গরম কাপড়ের অভাবে কষ্টে দিনাতিপাত করছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঠান্ডা নিবারণে খড়কুটা জ্বালাচ্ছে। এখানে মানুষের সঙ্গে গবাদি পশুও পড়েছে তীব্র ঠান্ডার কবলে। গৃহপালিত গবাদি পশুর মালিকরা ঠান্ডার আক্রমণ থেকে পশুগুলোকে রক্ষার্থে বস্তা গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছেন।

নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই কুড়িগ্রামের জনপদে ঠান্ডার তীব্রতা বেশি দেখা যায়। বছরের প্রথম দিন থেকে এখানে দুপুর পর্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন থাকছে। কুয়াশার সঙ্গে হিম বাতাস বয়ে যাওয়ায় এখানে বেড়ে যায় ঠান্ডার পরিধি। দুপুরে সূর্যের দেখা মিললেও বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার পর থেকে ঠান্ডার তীব্রতা আরও বাড়ে এখানে। নতুন বছরের দ্বিতীয় দিনে কুড়িগ্রামের তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে ঠান্ডার তীব্রতায় ১১ দশমিক পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠানামা করছে।

গ্রামের ঠান্ডা কাতর ভুক্তভোগী হাছেন আলী জানান, 'কুড়িগ্রামের পৌষের তীব্র ঠান্ডা বিরাজ করায় আমরা ঠান্ডার আক্রমণ থেকে বাঁচতে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুনের তাপ নিচ্ছি।'

মোকছেদুল হক জানান, 'এখানকার তীব্র ঠান্ডায় আমরা বাড়ির সদস্যদের নিয়ে কষ্টে আছি। নিজেদের সঙ্গে গবাদি পশুগুলোও কষ্ট পাচ্ছে। ঠান্ডা থেকে গবাদি পশুগুলোকে রক্ষা করতে বস্তার ছালা পশুর গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছি।'

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার জানান, কুড়িগ্রামে পৌষ মাসে ঠান্ডা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এখানে মাঝে মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশিতে উঠানামা করছে। তবে নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার সকালে কুড়িগ্রামের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ডোমার (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, নীলফামারীর ডোমারে ইংরেজি নতুন বছরের শুরুর দিন থেকেই জেঁকে বসেছে শীত। ঘন কুয়াশা, হিমেল হাওয়া আর কনকনে ঠান্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সোম ও মঙ্গলবার সারাদিন সূর্যের দেখা মেলেনি। ঘন কুয়াশা ও মেঘে ঢেকে রয়েছে আকাশ। হিমেল বাতাস আর কনকনে ঠান্ডায় কারণে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষজন। ক্ষেত খামারে, মাঠে ঘাটে লোকজনের উপস্থিতি কমে গেছে। প্রয়োজনের তাগিদে বের হওয়া মানুষকে সারাদিন গরম কাপড় গায়ে পরে ঘুরতে দেখা গেছে। রাস্তার পাশের গরম কাপড়ের দোকানে স্বল্প আয়ের মানুষের ভিড় বেড়েছে।

ডোমার পৌর এলাকার বাসিন্দা কৃষি শ্রমিক মজিবুল ইসলাম জানান, 'আমি মাঠে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। ঠান্ডায় ঘর থেকে বের হওয়াই কষ্ট। বাইরে ঠান্ডা বাতাসে শরীরে কাপুনি শুরু হয়। কনকনে ঠান্ডার কারণে দুইদিন ধরে কাজে যেতে পারিনি।'

সদর ইউনিয়নের ভুজারীপাড়া গ্রামের কৃষক সরল কুমার কর্মকার বলেন, ঠান্ডায় কাজ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ইরি-বোরো বীজতলা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন। তীব্র শীতে বীজতলা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

কনকনে ঠান্ডার কারনে শিশুদের ডায়রিয়া ও বয়স্কদের শ্বাসকষ্ট রোগ দেখা দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রায়হান বারী জানান, গত দুইদিন ধরে হাসপাতালে ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্ট রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময় শিশু এবং বৃদ্ধদের ঘরের বাইরে বের না হওয়াই ভালো। তবে বিশেষ প্রয়োজনে বের হতে হলে মুখে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, টানা শৈত্যপ্রবাহে কুড়িগ্রামের চিলমারীর জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে কেউ বের হচ্ছেন না। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। দুই বেলা কাজ না করলে অন্ন জোটে না এমন মানুষ শীতের প্রকোপে কাবু হয়ে গেছেন।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, মঙ্গলবার সকাল ৬টায় জেলায় সর্বনিম্ন ১৩.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। দিনে তাপমাত্রার চেয়ে রাতে তাপমাত্রা আরও কমবে।

উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের জোড়গাছ এলাকার আমির হোসেন বলেন, 'সারারাত কনকনে ঠান্ডা। দিনের বেলাতেও একই অবস্থা থাকছে। এমন অবস্থায় আমার মতো হোটেলে খেটে খাওয়া মানুষজনের কষ্টের শেষ নেই। কাজ না করে ঘরে বসে থাকলে তো পেটে ভাত জুটবে না। তাই কাজে যাচ্ছি।'

একই ইউনিয়নের নৌবন্দর এলাকার আজিজুল হক বলেন, দুইদিন ধরে খুব ঠান্ডা পড়েছে। সকালে উঠে জমিতে কাজে যেতে হয়। কাজ করতে গিয়ে হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, এভাবে ঠান্ডা থাকলে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে।

এদিকে, আমাদের হাওড়াঞ্চল প্রতিনিধি জানান, তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় মধ্যে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের জীবন রক্ষাকারী একমাত্র ফসল বোরো উৎপাদনের ধুম চলছে। কৃষকরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। হাওড়াঞ্চলের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ কৃষি ও ক্ষেত মজুর মিলে কাজ করছেন। কিশারগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে একমাত্র বোরো ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। এছাড়াও এ অঞ্চলে রয়েছে মেঘনা, গোড়াউত্তা, কালনী কুশিয়ারীসহ অসংখ্য নদী। এছাড়াও রয়েছে বিলমাকসা, বেড়িবিল, লুগুড়া, মুগুইড়া, বড়গোপ, ছোট গোপ, ছাইনা, মাইনা, ইত্যাদি বিভিন্ন ছোট বড় বিল বাদার। ফলে প্রাকৃতিক কারণেই এ অঞ্চলের আবাদি ভূমির ৭৫-৮০ ভাগই একমাত্র বোরো ফসল উৎপাদন হয় থাকে। বর্ষার পানি চলে যাওয়ার পর কৃষকরা বীজতলা তৈরি করে ধান বোপন করেন এবং অগ্রহায়ণের দিকে বীজতলায় তৈরি ধানের চারা মাঘমাস পর্যন্ত রোপণ করে থাকেন। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশা নিত্যদিন সাথী করে জমিতে হালচাষ, পানি উঠানে, সার প্রয়োগ ও চারা রোপণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন কৃষকরা। তবে গত দুই দিনের তীব্র শীতে হাওড়াঞ্চলের কৃষিসহ বিভিন্ন কর্মযজ্ঞে বেশ কষ্টে পড়েছেন খেটে খাওয়া লোকজন।

এ বিষয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অভিজিৎ সরকার জানান, অষ্টগ্রামে এবছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২৫ হাজার ২০৫ হেক্টর। এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ১৮ হাজর ১২০ হেক্টর। বর্তমানে বোরোর চারা রোপণ চলছে।

কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুস সাত্তার জানান, জেলায় এক লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও এখন (মঙ্গলবার) পর্যন্ত ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে