শিশুরা হলো এক একটি কোমল চারাগাছ, যা যত্ন ও পুষ্টি পেলে একটি দৃঢ় এবং ফলদায়ক বৃক্ষে পরিণত হতে পারে। তাদের আচরণ, মানসিকতা, এবং নৈতিক মূল্যবোধ গঠনের ক্ষেত্রে বড়দের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বড়দের প্রতিটি কথা, আচরণ এবং মনোভাব শিশুদের শেখার প্রক্রিয়ায় সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বড়দের আচরণ কীভাবে শিশুদের জীবনে প্রভাব ফেলে:
১. শিশুর কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতার বিকাশ
বড়দের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার মাধ্যমে শিশুরা তাদের সৃজনশীলতা বিকশিত করতে পারে। শিশুর আঁকা একটি সাধারণ ছবির প্রশংসা তাদের মধ্যে আরও নতুন কিছু করার উৎসাহ জাগিয়ে তোলে। বড়দের আচরণ যদি উদার এবং উৎসাহব্যঞ্জক হয়, শিশুরা কল্পনাশক্তির মাধ্যমে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করে।
২. আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা
বড়রা যদি শিশুর অর্জন ও প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন, তাহলে শিশুর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। যেমন- একটি শিশু কোনো কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করলে তাকে প্রশংসা করুন। এটি তাকে আরও কঠিন কাজ করার উৎসাহ দেবে।
৩. শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি
শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা বড়দের আচরণের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে। শিশুরা যদি দেখে যে বড়রা বই পড়ছে, প্রশ্ন করছে বা নতুন কিছু শিখতে চায়, তাহলে তারাও একই আচরণ অনুসরণ করবে। বড়রা যদি শিশুর প্রতিটি নতুন অর্জনকে উদযাপন করে, তবে তা তাদের শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ায়।
৪. খেলাধুলা এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ
শিশুরা খেলাধুলা বা শৈল্পিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে পারে।
শারীরিক শিক্ষা: খেলাধুলার মাধ্যমে তারা দলগত কাজ, নেতৃত্ব, এবং অধ্যবসায় শেখে।
শিল্প ও সংস্কৃতি: সঙ্গীত, নৃত্য, ছবি আঁকা বা গল্প বলার মতো কার্যক্রম তাদের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়তা করে।
বড়রা যদি এসব কার্যক্রমে তাদের সঙ্গী হন এবং উৎসাহ দেন, তাহলে শিশুরা নিজেদেও সীমাবদ্ধতাগুলো ভেঙে নতুন কিছু শেখার সাহস পায়।
বড়দের আচরণে সংবেদনশীলতার ভূমিকা:
১. সমতার শিক্ষা
শিশুরা বড়দের কাছ থেকে সমতার ধারণা শিখে। যদি বড়রা সবার প্রতি সমান আচরণ করে, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে ভেদাভেদ না করে, তাহলে শিশুরাও এসব মূল্যবোধ আত্মস্থ করে।
২. ক্ষমাশীলতা শেখা
শিশুরা ক্ষমাশীলতার মূল্য শিখতে পারে বড়দের কাছ থেকে। যেমন- বড়রা যদি কোনো ভুল ক্ষমা করে এবং অন্যদের ভুলে উন্নতি করতে উৎসাহ দেয়, শিশুরাও তা গ্রহণ করবে।
৩. শিশুর অনুভূতিগুলোকে মূল্য দেওয়া
শিশুরা প্রায়ই নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। বড়রা যদি তাদের অনুভূতিগুলো গুরুত্ব দিয়ে শোনে, তাহলে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাদের কষ্টের কথা শোনা এবং তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজতে সহায়তা করা একটি শিশু-বান্ধব আচরণ।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে বড়দের আচরণের গুরুত্ব:
১. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো
আজকের দিনে শিশুরা প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে উঠছে। বড়দের উচিত তাদের প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার শেখানো। বড়রা যদি সঠিক সময় প্রযুক্তি ব্যবহার করেন এবং শিক্ষার কাজে এটি ব্যবহার করেন, তাহলে শিশুরাও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে।
২. স্থূল আচরণ থেকে বিরত থাকা
বড়রা যদি নিজেদের রাগ, বিরক্তি বা হতাশা শিশুর ওপর প্রকাশ করে, তাহলে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
শিশুর প্রতি বড়দের আচরণ পরিবর্তনের উপায়:
১. শিশুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
২. তাদের মতামত গুরুত্ব দিন।
৩. তাদের চিন্তার স্বাধীনতা দিন।
৪. তাদের ভুল থেকে শিখতে সাহায্য করুন।
৫. শিশুরা বড়দের জন্য বোঝা নয় বরং অনুপ্রেরণা, এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলুন।
পরিশেষে বলা যায়, বড়দের আচরণ শিশুর ভবিষ্যত গঠনের প্রধান হাতিয়ার। তাদের ভালোবাসা, যত্ন, ধৈর্য এবং নৈতিক শিক্ষা শিশুকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। বড়রা যদি নিজেদের আচরণে আরও সংবেদনশীল এবং দৃষ্টিভঙ্গি-সমৃদ্ধ হন, তাহলে তারা একটি শিশুর জীবনে এমন প্রভাব রাখতে পারবেন যা তাকে সারাজীবনের জন্য অনুপ্রাণিত করবে।
পিএইচডি গবেষক