অল্টারনেটিভ মেডিসিন সেক্টরের সমস্যা ও সম্ভাবনাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে এ খাতের বিকাশে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুন। তিনি দীর্ঘদিন ন্যাচারাল মেডিসিনের শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তার লেখা অনেক গ্রন্থ এ সেক্টরের শিক্ষার্থীদের জ্ঞানান্বেষণকে সহজ করেছে। 'মানবিক মানবী' হিসেবে ইতোমধ্যে মানুষের ভালোবাসায় ধন্য হয়েছেন। তার স্নেহের ছায়ায় ঠাঁই পেয়েছেন গৃহহীন, কর্মহীন, সহায়-সম্বলহীন ও হতাশাগ্রস্ত অসংখ্য পরিবার। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একমাত্র বেসরকারি ইউনানি ডিগ্রি কলেজ 'রওশন জাহান ইস্টার্ণ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল' লক্ষ্ণীপুরের অধ্যক্ষ। তিনি একাধারে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা। নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন অল্টারনেটিভ মেডিসিন সেক্টরের উন্নয়নে। ব্যক্তিগত জীবনে তার স্বামী ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া দেশের শীর্ষ ইউনানি আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠান হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াক্ফ) বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গম্প্রতি অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুনের সঙ্গে ন্যাচারাল মেডিসিন, ইউনানি-আয়ুর্বেদিক শিক্ষা, তার বিভিন্ন মানবিক উদ্যোগ নিয়ে এক আলাপচারিতা হয়। এর চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো: প্রশ্ন: বাংলাদেশে ন্যাচারাল মেডিসিনের সম্ভাবনা কেমন? অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুন: বাংলাদেশ ওষুধি উদ্ভিদ, হার্বস, লতাপাতার উর্বর ভূমি হওয়া সত্ত্বেও এখনো এর যথাযথ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে সিনথেটিক ওষুধ ও ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহারের বিপরীতে ন্যাচারাল মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন উপকারিতা সম্পর্কে মানুষ সচেতন হচ্ছে- আগ্রহ বাড়ছে। এ সেক্টরে দরকার পর্যাপ্ত গবেষণা ও পৃষ্ঠপোষকতা। এখন ন্যাচারাল মেডিসিন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ডোজ আকারে নির্দিষ্ট মাত্রা ও সময়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাচ্ছে। ফলে, এ সেক্টরের ব্যাপক বিস্তৃতির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রশ্ন: কীভাবে এ সেক্টরে দীর্ঘমেয়াদি সফলতা আনা যায়? অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুন : অল্টারনেটিভ মেডিসিন শিক্ষার বিস্তার জরুরি। দেশে কিছু ডিপেস্নামা কলেজ থাকলেও ডিগ্রি পর্যায়ে মাত্র ১টি সরকারি ও ৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বলাবাহুল্য, বেসরকারি ৩টি প্রতিষ্ঠানই হামদর্দ বাংলাদেশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। অন্যদেরও এগিয়ে আসা দরকার। দক্ষ চিকিৎসক ও জনশক্তি গড়ে উঠলে এর বিস্তৃতি দীর্ঘমেয়াদি হবে। এ সেক্টরের ক্রমবর্ধমান সফলতায় সব এলোপ্যাথিক চিকিৎসক নিয়মিত প্রেসক্রাইব করছে। এর গুণাগুণ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চাকরির সুবিধা বৃদ্ধি করা দরকার। প্রশ : আপনি সম্প্রতি হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুন : প্রায় ১৬০ বিঘা বিস্তৃত মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে- যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের মেঘনা ব্রিজ সংলগ্ন ফুলদি নদীর তীরে এটি অবস্থিত। ক্যাম্পাসের একপাশে রয়েছে শত শত ওষুধি উদ্ভিদের সমৃদ্ধ ভেষজ বাগান। অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানে প্রায় সব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রির সুযোগ রয়েছে। সিএসই, ইইই, ইংরেজি, অর্থনীতি, গণিত, বিবিএ, এমবিএসহ অন্যান্য আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পরিচালনায় রয়েছে দক্ষ শিক্ষকমন্ডলী। ঢাকা, কুমিলস্নাসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে ফ্রি বাস সার্ভিসের সুবিধা রয়েছে। তাছাড়া, ছাত্রছাত্রীদের জন্য পৃথক ও নিরাপদ আবাসন সুবিধা রয়েছে। এ ক্যাম্পাসের মধ্যে রয়েছে দেশের একমাত্র ত্রি-মাত্রিক জেনারেল হাসপাতাল। এখানে ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার সুবিধা রয়েছে। যা আশপাশের মুন্সীগঞ্জ গজারিয়াবাসীর চিকিৎসা সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একমাত্র ইউনানি-আয়ুর্বেদিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'হামদর্দ ইনস্টিটিউট অব ইউনানি অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক মেডিসিন'। এখানে ভারতের আয়ুশ মন্ত্রণালয়ের নিযুক্ত আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এবং শ্রীলঙ্কার বিশিষ্ট ইউনানি চিকিৎসক ফ্যাকাল্টি হিসেবে নিয়মিত শিক্ষা দান করছেন। হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ হলো হামদর্দ বিজ্ঞান নগরীর প্রাথমিক ধাপ। হামদর্দ বাংলাদেশ-এর রূপকার ও হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়ার স্বপ্নের 'হামদর্দ শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি নগরী' প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমি গর্বিত ও আনন্দিত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষে এটি অচিরেই একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে পরিণত হবে। হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে গরিব মেধাবীদের জন্য বিশেষ সুবিধা আছে। প্রশ্ন : হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট কি? ভর্তিচ্ছুদের জন্য নতুন কোনো বার্তা আছে? অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুন: প্রথমেই বলেছি, এটি খোলামেলা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে। যা শিক্ষার্থীদের মননশীলতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সন্নিবেশ ঘটানো হচ্ছে এখানে। রয়েছে গবেষণার নানা উপকরণ। হামদর্দসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির অগ্রাধিকার পাবে এর শিক্ষার্থীরা। মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে আমরা সচেষ্ট রয়েছি- যা দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য। প্রশ্ন: আপনি অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত, মানসিক ভারসাম্যহীন, নিগৃহীত সংখ্যালঘুসহ এতিম শিশুদের জন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এসব কাজের অনেক কিছুই প্রচার-প্রচারণা ও লোকচক্ষুর আড়ালে; কেন? অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুন : আমরা যে যার সামর্থ্যমতো অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মাঝে আনন্দ ও আত্মতৃপ্তি আছে। আপনার একটু সহায়তা আরেকজনের পরিত্রাণের সহায়ক হতে পারে। আমরা মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ বিবেচনায় নেয়ার দরকার নেই। মানুষের চেয়ে বড় পরিচয় আর কি হতে পারে! এতিমখানাগুলোকে শুধু অবহেলিত অসহায় শিশুদের আশ্রয়স্থল নয়; তাদের শারীরিক মানসিক বিকাশের মাধ্যমে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিকাশ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। তাহলে তাদের মধ্যে বৈষম্য ও হীনম্মন্যতা তৈরি হবে না। প্রশ্ন: আপনাকে একটি সংস্থা 'মানবিক মানবী' হিসেবে সম্মাননা দিয়েছে। হামদর্দকে বলা হয়, 'ব্যথার সাথী'। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মানবিক উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই। অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুন: আমাদের সদিচ্ছা থাকলে আমরা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। চেষ্টা ও ইচ্ছে থাকলে সেটি ক্রমশ: বিস্তৃত করা যায়। হামদর্দ একটি ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান। 'হামদর্দ অর্থ ব্যথার সাথী'। প্রতিষ্ঠান হিসেবে হামদর্দ মানব কল্যাণে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। করোনাকালে, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ায় হামদর্দ। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও ওষুধ বিতরণ অনন্য উদ্যোগ। এটাও আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। প্রশ্ন: ন্যাচারাল মেডিসিন সম্পর্কে শেষ কথা কি? অধ্যাপক কামরুন নাহার হারুন :বাংলাদেশে ন্যাচারাল মেডিসিনের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো দরকার। এটি আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতিকে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে। একদিকে, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন; অন্যদিকে, বৈদেশিক মুদ্রার সুযোগ আমাদের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করবে।