বর্তমান সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা আমাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। একদিকে দ্রম্নত পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক অবস্থা এবং জীবনযাত্রার ব্যস্ততা, অন্যদিকে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের মধ্যে উদ্বেগ এবং হতাশা বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সুখ হরমোন, যেমন ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন এবং এন্ডোরফিনের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুখ হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় কিছু কার্যকরী কৌশল অনুসরণ করলে মানসিক স্বস্তি ও আনন্দ অনুভব করা সম্ভব।
সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি করুন
চলমান সামাজিক দূরত্ব এবং যোগাযোগহীনতার কারণে মানসিক চাপে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই পরিস্থিতিতেও পরিবারের সদস্য, বন্ধু এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আমাদের মানসিক স্বস্তি ও সুখানুভূতি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অক্সিটোসিন, যাকে সাধারণত 'লাভ হরমোন' বলা হয়, আমাদের বন্ধন ও সংযোগের অনুভূতি তৈরি করে। পরিবার ও প্রিয়জনদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করা সম্ভব না হলে, ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথা বলা বা ভিডিও কল করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে মনোভাব উন্নত হয়, একাকীত্ব দূর হয় এবং মানসিক প্রশান্তি আসে। সহমর্মিতা ও সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমেও অক্সিটোসিনের নিঃসরণ বাড়ে- যা আমাদের সুখানুভূতি এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম করুন
বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের মানসিক শান্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। মেডিটেশন এবং যোগব্যায়াম মানসিক চাপ কমানোর একটি কার্যকরী উপায়- যা সেরোটোনিন নিঃসরণে সহায়তা করে ও মানসিক প্রশান্তি আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন ১৫-২০ মিনিট মেডিটেশন করলে এবং নিয়মিত যোগব্যায়াম চর্চা করলে মানসিক চাপ কমে যায় এবং মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ও ধৈর্য বৃদ্ধি পায়। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উৎসাহ ও ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখতে সহায়তা করে।
শারীরিক ব্যায়াম করুন
শারীরিক ব্যায়াম আমাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের ব্যায়াম যেমন- হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং বা যে কোনো ধরনের শারীরিক চর্চার মাধ্যমে এন্ডোরফিন নিঃসৃত হয়- যা আমাদের আনন্দ এবং প্রশান্তি এনে দেয়। প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে এন্ডোরফিনের নিঃসরণ হয়- যা আমাদের মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মস্তিষ্কের ডোপামিন নিঃসরণে সহায়তা করে- যা আমাদের সুখানুভূতি এবং উদ্দীপনা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটান
প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটানো মানসিক প্রশান্তি আনার জন্য একটি সহজ ও কার্যকরী উপায়। এটি আমাদের ডোপামিন ও সেরোটোনিনের নিঃসরণ বাড়াতে সহায়তা করে। প্রাকৃতিক পরিবেশে হাঁটা বা সবুজের মাঝে সময় কাটানো মস্তিষ্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং একাকীত্ব কমায়। খোলা বাতাসে কিছু সময় কাটালে মানসিক প্রশান্তি আসে এবং চিন্তাভাবনা স্পষ্ট হয়- যা আমাদের দুশ্চিন্তা কমাতে সহায়তা করে।
সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন
বর্তমান অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে অনেকেই খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে অসচেতনতা দেখান- যা সুখ হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস আমাদের সুখ হরমোনের নিঃসরণকে সুষম রাখতে সহায়ক। বাদাম, চকলেট, মাছ এবং সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি খাবার আমাদের ডোপামিন ও সেরোটোনিনের নিঃসরণ বাড়ায় এবং মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। খাবারে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান গ্রহণ করলে আমাদের দেহ সুস্থ থাকে এবং মন প্রফুলস্ন হয়। বিশেষ করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ট্রিপ্টোফ্যানসমৃদ্ধ খাবারগুলো মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের নিঃসরণ বাড়াতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
বিনোদন ও সৃজনশীল কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখুন
অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক চাপে অনেকে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এ সময় নিজের পছন্দের কোনো শখ বা সৃজনশীল কাজের মাঝে নিজেকে নিয়োজিত রাখলে মন হালকা হয় এবং মানসিক প্রশান্তি আসে। গান শোনা, ছবি আঁকা, বই পড়া বা সৃজনশীল কাজ করলে মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়ে- যা সুখানুভূতি সৃষ্টি করে এবং চাপ কমায়। শখের কাজ করা যেমন আমাদের মন ভালো করে, তেমনি এতে নতুন কিছু শেখার সুযোগও থাকে। নিয়মিত সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকলে আমাদের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হয় এবং মানসিক প্রশান্তি বজায় থাকে।
সংযত জীবনযাপন করুন
বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেই অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আছেন। অর্থনৈতিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে সংযত জীবনযাপন এবং বাজেট অনুযায়ী ব্যয় করাই হলো সঠিক উপায়। পরিকল্পিত জীবনযাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উদ্বেগ অনেকটাই কমানো যায়। ব্যয় সংকোচন এবং বাজেট অনুযায়ী খরচ করলে আর্থিক সংকট কমে এবং মানসিক চাপ হ্রাস পায়। প্রয়োজনে অর্থনৈতিক পরামর্শক বা পেশাদার সহায়তা গ্রহণ করাও সহায়ক হতে পারে। অর্থনৈতিক সুরক্ষা আমাদের সুখ হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে এবং উদ্বেগমুক্ত জীবনযাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।