এমপক্স. আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এমপক্সের কোনো উলেস্নখযোগ্য প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। ২০২২ সালের বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাবের সময়েও বাংলাদেশে কোনো নিশ্চিত কেস রিপোর্ট করা হয়নি। তবে, বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের কারণে বাংলাদেশেও এ রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, নীলফামারী সদর, নীলফামারী। (চিকিৎসক, কবি, ছড়াকার, লেখক ও কলামিস্ট)
এমপক্স. পূর্বে যেটি মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল, একটি ভাইরাসজনিত রোগ- যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। এমপক্স. ভাইরাসটি অর্দথোপক্সভাইরাস প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত, যেখান থেকে স্মলপক্স এবং ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাসও এসেছে। ১৯৫৮ সালে প্রথমবার দুটি গবেষণা করা বানরের কলোনিতে পক্স-জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, যেখানে এই ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত করা হয়। এ কারণে এর নামকরণ হয় মাঙ্কিপক্স। ১৯৭০ সালে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে প্রথম মানব সংক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়। এমপক্স মূলত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার কিছু দেশ যেমন গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং গ্যাবনে বেশি পরিলক্ষিত হয়। গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে এই রোগটি বেশি ঘটেছে এবং বহুবার সেখানে রিপোর্ট করা হয়েছে। আফ্রিকার বাইরে, এমপক্স. সাধারণত খুবই বিরল ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে, এটি বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায়। এটি প্রথমবারের মতো আফ্রিকার বাইরে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা পূর্বে দেখা যায়নি। এমপক্স. একটি জুনোটিক রোগ- যা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। সেন্ট্রাল এবং ওয়েস্ট আফ্রিকার কিছু বন্যপ্রাণীতে এই ভাইরাসটি বিরাজমান বলে ধারণা করা হয়, বিশেষ করে ইঁদুর এবং অন্যান্য ছোট প্রাণীদের মধ্যে। সংক্রমিত প্রাণীর রক্ত, শরীরের তরল বা ত্বকের ক্ষতের সংস্পর্শে এলে মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। এটি মূলত ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শ, শ্বাসতন্ত্রের নিঃসরণ বা সংক্রমিত বস্তুর সংস্পর্শের মাধ্যমেও ছড়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটার ঘটনা জানা গেছে, বিশেষ করে সমকামী পুরুষদের মধ্যে। এনডেমিক এলাকায়, এমপক্স. প্রধানত ১৫ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে সব বয়সের মানুষ এতে আক্রান্ত হতে পারে। পুরুষ এবং নারী উভয়েই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তবে ২০২২ সালের প্রাদুর্ভাবে প্রায়ই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা গেছে, বিশেষ করে সমকামী পুরুষদের মধ্যে। যেসব মানুষ এনডেমিক এলাকায় বাস করেন বা ভ্রমণ করেন- যারা সংক্রমিত প্রাণী বা ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা এই রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। ২০২২ সালের প্রাদুর্ভাবটি সমকামী পুরুষদের মধ্যে সংক্রমণের হার উলেস্নখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। এমপক্সের ইনকিউবেশন পিরিয়ড সাধারণত ৫ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষণ ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। সংক্রমিত ব্যক্তিদের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে বিশেষ করে ফুসকড়ি দেখা দেওয়ার পর পুরু অংশ নতুন ত্বক গঠিত হওয়া আগ পর্যন্ত তারা সংক্রামিত থাকেন। সাধারণত জ্বর, মাথাব্যথা, পেশির ব্যথা এবং ক্লান্তি দিয়ে এই রোগের শুরু হয়। লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া এই রোগের একটি স্বতন্ত্র লক্ষণ। জ্বর শুরু হওয়ার পর, শরীরে একটি ফুসকুড়ি দেখা যায়- যা মুখ থেকে শুরু হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই ফুসকুড়ি বিভিন্ন ধাপে পরিবর্তিত হয়, যেমন ম্যাকুলস (সমান ক্ষত), প্যাপুলস (উঁচু ক্ষত), ভেসিকুলস (তরল পূর্ণ ফোস্কা), পাস্টুলস (পুঁজ) এবং শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত অংশ পুরু হয়ে যায়। রোগটি সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। ২০২২ সালে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০,০০০ টিরও বেশি কেস রিপোর্ট করা হয়- যা ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এটি সমকামী পুরুষদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্যভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছিল। ২০১৭ সাল থেকে নাইজেরিয়ায় এমপক্স. কেসের বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। স্মলপক্সের টিকা বন্ধ হওয়ার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াও এটির একটি কারণ হতে পারে। এমপক্সের কেস ফ্যাটালিটি রেট বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন হতে পারে এবং এটি ভাইরাসের স্ট্রেন এবং স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা ওপর নির্ভর করে। সাধারণত এই ক্লেডের কেস ফ্যাটালিটি রেট প্রায় ১০%। ২০২২ সালের প্রাদুর্ভাবে, ফ্যাটালিটি রেট কম ছিল- যা ভালো স্বাস্থ্যসেবা এবং আক্রান্ত কেসগুলো মৃদু হওয়ার কারণে সম্ভব হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো এমপক্স. প্রতিরোধে বিভিন্ন নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে। সংক্রমিত ব্যক্তিদের আলাদা করা, আক্রান্তদের শনাক্ত করা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার নিশ্চিত করা এই নির্দেশনাগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এমপক্স. প্রতিরোধে স্মলপক্সের টিকা কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এমভিএ-বিএন টিকা- যা মূলত স্মলপক্সের জন্য তৈরি, হাই-রিস্ক জনসংখ্যার মধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। এমপক্সের লক্ষণ, সংক্রমণের পদ্ধতি এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এই রোগের নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এনডেমিক অঞ্চলে সম্ভাব্য প্রাণী সংরক্ষণের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ কমানো জুনোটিক সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এমপক্সের কোনো উলেস্নখযোগ্য প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। ২০২২ সালের বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাবের সময়েও বাংলাদেশে কোনো নিশ্চিত কেস রিপোর্ট করা হয়নি। তবে, বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের কারণে বাংলাদেশেও এ রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাবের পর, বাংলাদেশ সরকার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে এমপক্স. সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের নজরদারি এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করা। বিমানবন্দর এবং স্থলবন্দরগুলোতে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, বিশেষত যেসব যাত্রী আফ্রিকা বা এমপক্স.-প্রবণ দেশগুলো থেকে আসছেন তাদের তাপমাত্রা মাপা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং সন্দেহভাজন কেসগুলো আলাদাভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা এমপক্স. সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে চলেছে। টিভি, রেডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এমপক্সের লক্ষণ, সংক্রমণ পদ্ধতি এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ সম্পর্কে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। এমপক্স. শনাক্ত করার জন্য বাংলাদেশে বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি সক্ষমতা বিদ্যমান। দেশের বিভিন্ন প্রধান হাসপাতাল এবং ল্যাবরেটরি এমপক্স. শনাক্ত করার জন্য পিসিআর টেস্ট করতে সক্ষম। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোকে এমপক্স. কেস পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে- যাতে তারা রোগী সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে এবং দ্রম্নত ব্যবস্থা নিতে পারেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো এখনো অনেক সীমিত- যা কোনো প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে দ্রম্নত প্রতিক্রিয়া জানানো কঠিন করে তোলে। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনো এমপক্স. সম্পর্কে সচেতন নয়- যা রোগের বিস্তার ঘটার ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ বিদেশে কাজ করতে যান, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কিছু দেশে। এসব দেশে এমপক্সের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে এই রোগের আমদানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমপক্স. এবং অন্যান্য জুনোটিক রোগ সম্পর্কে আরো গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রাদুর্ভাব ঘটলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দ্রম্নত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমপক্স. বর্তমানে একটি বড় হুমকি নয়, তবে এর সম্ভাব্যতা বিবেচনা করে সরকার এবং স্বাস্থ্য বিভাগ প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, শক্তিশালী নজরদারি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ এই রোগের সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় প্রস্তুত হচ্ছে।