শ্বেতী (ভিটিলিগো) বা ত্বকের সাদা দাগ এক ধরনের 'অটো-ইমিউন ডিজিজ'। ভিটিলিগো বা শ্বেতী নিয়ে সমাজে নানা ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত আছে। কেউ কেউ একে অভিশাপ মনে করেন। এই সাদা দাগের সঙ্গে কুষ্ঠ রোগের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সেই আতঙ্কে আক্রান্ত মানুষটি ও তার পরিবার অনেক বেশি ভেঙে পড়েন। দেখতে শ্রীহীন লাগা ছাড়া শ্বেতীর অন্য কোনো বিপজ্জনক দিক নেই।
শরীরের 'ইমিউন সিস্টেম' বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অজ্ঞাত কোনো কারণে নিজের শরীরের বিভিন্ন কোষ ও কলাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই জাতীয় রোগকে বলা হয় 'অটো-ইমিউন ডিজিজ'।
ত্বকের ভেতের থাকা মেলানোসাইট কোষ মেলানোজেনেসিস (অর্থাৎ ত্বকের রঞ্জক মেলানিন তৈরির প্রক্রিয়া) পদ্ধতিতে মেলানিন তৈরি করে। এই মেলানিনই ফর্সা বা কালো রঙের কারণ। বেশি মেলানিন হলে গায়ের রং কালো, মাঝামাঝি হলে বাদামি আর কম হলে ফর্সা হয়। মেলানোজেনেসিস প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হলে ত্বক হয়ে ওঠে দুধ সাদা। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেরাই মেলানোসাইট কোষকে ধ্বংস করে দেয় এই রোগে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিলে রক্তে এক ধরনের শ্বেত কণিকা- লিম্ফোসাইট বেড়ে যায়। ধারণা করা হয়, এরাই মেলানোসাইট কোষ ধ্বংস করে। ভিটিলিগো, শ্বেতী বা লিউকোডার্মা যে নামেই ডাকি না কেন এই রোগের একটাই উপসর্গ - ধবধবে সাদা দাগ। কোনো জ্বালা, ব্যথা বা চুলকানি কিছুই থাকে না।
অটো-ইমিউন ডিজিজ ছাড়াও নানা কারণে ত্বকে সাদা দাগ হতে পারে। আলতা, সিঁদুর বা প্রসাধনীসামগ্রী ব্যবহৃত ক্যামিক্যালের প্রভাবে অথবা পস্নাস্টিকের স্যান্ডেল দীর্ঘদিন পরলে অনেকের ত্বকে সাদা দাগ হতে দেখা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে কেমিক্যাল লিউকোডার্মা বলা হয়। আবার অনেক দিন ধরে শক্ত করে বেল্ট বেঁধে পোশাক পরলেও কোমরে এক ধরনের সাদা দাগ দেখা দেয়। যথাযথ চিকিৎসায় সবই সেরে যায়। অনেকেই নানা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে শ্বেতীর চিকিৎসা করাতে ভয় পান। এই ধরনের ভাবনার কোনো ভিত্তি নেই।
শ্বেতী বংশগত ভাবেও হয়। প্রতি ১০০ জন শ্বেতী রোগীর মধ্যে ৩০ জনের ক্ষেত্রেই শ্বেতী হয় বংশগত ধারায়, মাতৃকুল বা পিতৃকুলের কারও না কারও থেকে জিনের প্রভাবে হয়ে থাকে। বাকি ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে শ্বেতী সাদা দাগ ছড়াতে থাকে নিজস্ব কারণে- যার মূলে রয়েছে মেলানিনের কারসাজি! বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ শ্বেতীতে আক্রান্ত।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে শ্বেতীকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়- সেগমেন্টাল ও নন-সেগমেন্টাল। নন-সেগমেন্টাল শ্বেতী কখনো দ্রম্নত আবার কখনো ধীরে ধীরে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সেগমেন্টাল শ্বেতী নির্দিষ্ট একটি স্থানে সীমিত হয়।
সাধারণত মুখমন্ডল, কনুই, বুকের ত্বক প্রথমে আক্রান্ত হতে শুরু করে। কখনো কখনো চোখের পাশ দিয়ে, নাকের দুই পাশে বা ঠোঁটের কোণ বা ওপরের ত্বকেও শুরু হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে শ্বেতী খুব একটা ছড়ায় না, একটা বিশেষ জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। আবার কারও এমনভাবে মুখে, বুকে, হাতে, পায়ে ছড়িয়ে পড়ে যে বোঝাই যায় না এক সময় গায়ের রং আসলে কী ছিল। দ্বিতীয় ধরনের শ্বেতীর দাগই মানুষকে শ্রীহীন করে তোলে। ৫০ শতাংশ শ্বেতী ধরা পড়ে বয়স দশ বছর হওয়ার পর।
শ্বেতী রোগে করণীয়
দ্ব এটি একটি অটো-ইমিউন রোগ, আর এর সঙ্গে অন্যান্য অটো-ইমিউন রোগ সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে। যেমন পরিপাকতন্ত্রের কিছু সমস্যা, থাইরয়েড বা অন্যান্য হরমোনের রোগ, টাইপ-১ ডায়াবেটিস ইত্যাদি। তাই অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সমস্যার দিকেও নজর দিতে হবে।
দ্ব শ্বেতী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। মানসিক চাপ রোগটিকে ত্বকের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। কারণ, মানসিক চাপ ইমিউন সিস্টেমকে আরও দুর্বল করে দেয়।
দ্ব ক্যাফেইন, ডার্ক চকলেট, গস্নুটেন এবং সাইট্রাস জাতীয় ফলের মতো কিছু সাধারণ খাবার শ্বেতী রোগকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। ভিটামিন-বি এবং অ্যামিনো এসিডসমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যামিনো এসিড পাওয়া যায় প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারে। এছাড়া অন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য খাবার তালিকায় প্রোবায়োটিকস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দ্ব অনেকেই শ্বেতী রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে ত্বকের বাইরের অংশে কিছু উপকরণের প্রয়োগ করে থাকেন। যেমন হলুদের গুঁড়া ও সর্ষের তেলের মিশ্রণ। এতে ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া তুলসী বা পুদিনা পাতা পিষে তা লেবু রসে মিশিয়ে পেস্ট করে অনেকে ব্যবহার করেন, যা করা যাবে না।
দ্ব শ্বেতী রোগের আরেকটি কারণ হলো কপারের ঘাটতি। বাদাম, বীজ এবং সবুজ সবজি কপার সমৃদ্ধ খাবার। তামার পাত্রে সংরক্ষণ করা পানি পান করে উপাদানটির ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। আয়রন ও দস্তাসমৃদ্ধ খাবারও গুরুত্বপূর্ণ। বাদাম, বীজ, শাক এবং সবুজ সবজি দস্তা সমৃদ্ধ খাবার।
দ্ব শ্বেতী নিয়ে ভালো থাকতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা। সুতরাং, সক্রিয় থাকতে হবে, প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে ও পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে।
চিকিৎসা
দ্ব মনে রাখতে হবে শ্বেতী নিরাময় যোগ্য নয়। একে নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বের রঙে ফেরত আনা যায় শুধু।
দ্ব প্রাথমিক অবস্থায় ন্যারো ব্যান্ড আল্ট্রা ভায়োলেট (এন বি-ইউ ভি) ফটো থেরাপিতে অনেক সময়েই শ্বেতী সেরে যায়।
দ্ব ছোট আকৃতির ও সীমিত আকারের শ্বেতী ত্বকে লাগানোর মলম বা মুখে খাওয়ার ওষুধে পূর্বের রঙে ফেরত আসে।
দ্ব চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মলম লাগানো বা ওষুধ সেবনের পাশাপাশি সকাল বেলার মিষ্টি রোদ লাগাতে হবে শ্বেতী আক্রান্ত স্থানে।
দ্ব বড় আকারের শ্বেতী হলে মলম আর ওষুধে কাজ নাও হতে পারে। ওষুধে কাজ না হলে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে।
দ্ব শ্বেতী চিকিৎসায় যে অস্ত্রোপচার করা হয়, তার নাম পাঞ্চ গ্রাফটিং। যে ধরনের শ্বেতী বছর দুয়েক মোটামুটি একই জায়গায় অবস্থান করে, সেই শ্বেতী সারিয়ে তুলতে পারে এই পাঞ্চ গ্রাফটিং।
দ্ব অত্যাধুনিক 'মেলানোসাইট ট্রান্সফার' পদ্ধতিতে ত্বকের স্বাভাবিক অংশ থেকে মেলানোসাইট নিয়ে সাদা অংশে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, এতে ক্রমশ ত্বক পুরনো রূপ ফিরে পায়।
ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা শ্বেতীকে অসুখের পর্যায়েই ফেলেন না। শ্বেতীর দাগ মেলাতে তারা 'ওয়াটার রেজিস্ট্যান্ট কভার' ব্যবহার করেন। আর আমাদের দেশের মানুষ অসুখ নিয়ে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেন, ডিপ্রেশনে ভোগেন। যত দ্রম্নত শ্বেতীর চিকিৎসা শুরু করা যায় ততোই ভালো। তাই শরীরের যে কোনো জায়গায় সাদা দাগ দেখা দিলে দ্রম্নত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, নীলফামারী সদর, নীলফামারী।