রাগ অতি পরিচিত একটি শব্দ। সারাক্ষণই রেগে থাকেন এমন মানুষের সংখ্যা যেমন কম নয়, তেমনি হুট করে রেগে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও অনেক। রাগের ধরন যেমনই হোক না কেন, তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। রাগ একটি স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা যা অনুভূতিতে আঘাতের ফলে সৃষ্ট একটি অস্বস্তিকর এবং অসহযোগী প্রতিক্রিয়া। রাগের ফলে,কোনো ব্যক্তি মানসিক চাপের পাশাপাশি প্রায়ই শারীরিক প্রভাব অনুভব করেন। যেমন: রাগের কারণে হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ, এড্রেনালিন ও নর-এড্রেনালিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। কেউ কেউ রাগকে একটি আবেগ হিসেবে মনে করেন- যা অস্বস্তিকর উত্তেজনার সৃষ্টি করে; শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রাগের বাহ্যিক অভিব্যক্তি মুখের ভাষা, শরীরের ভাষা, শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া ও মাঝে মাঝে জনসাধারণের ওপর আগ্রাসনী আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করতে দেখা যায়। সাধারণত যারা রেগে যান তাদের বেশিরভাগ মানুষেই রাগের কারণ তুলে ধরেন। তবে রাগান্বিত ব্যক্তি খুব সহজেই বড় ধরনের ভুল করে ফেলতে পারেন। কারণ, রাগ তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। অনিয়ন্ত্রিত রাগ আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে, আবার সামাজিক অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়।
সাধারণত সব মানুষের মাঝেই মাত্রাভেদে কম বেশি রাগের উপস্থিতি পাওয়া যায়- যা স্বাভাবিক। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারও কারও মাঝে অতিরিক্ত রাগ লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত রাগকে মানসিক সমস্যা মনে করে থাকেন। সেক্ষেত্রে বলা যায়, রাগ বা অতিরিক্ত রাগ স্বতন্ত্র কোনো মানসিক সমস্যা নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা অতিরিক্ত রাগের কারণ হতে পারে। যেমন: বাই পোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, সিভিয়ার ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি), হরমোনের মাত্রার তারতম্যজনিত রোগ ইত্যাদি। এছাড়াও কোনো কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অতিরিক্ত মাদক সেবনের নেতিবাচক প্রভাব, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি রাগের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রেগে যাওয়ার কারণসমূহ
হ শারীরবৃত্তীয় কারণ:
দ্ব মগজের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের ভূমিকা: মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হলো প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স তুলনামূলক কম সক্রিয় তাদের আচরণ আগ্রাসী হয়, রাগ বেশি হয়ে থাকে।
দ্ব টেস্টোস্টেরণ হরমোনের প্রভাব: অগ্রাসী আচরণে হরমোনের প্রভাব বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের শরীরে টেস্টোস্টেরণ হরমোন উচ্চ মাত্রায় বিদ্যমান, তাদের আচরণ পাশবিক হয়।
দ্ব নিউরোট্রান্সমিটারের ভূমিকা: আমাদের মানসিক ভারসাম্য বজায়ে রাখতে নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর মধ্যে সেরোটনিনের ভূমিকা বেশি। সেরোটোনিনকে বলা হয় সুখানুভূতির রসায়ন। সেরোটোনিনের মাত্রায় যখন পরিবর্তন দেখা দেয়, তখন মানুষ তার আচরণে স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে।
হ মানসিক কারণ:
ব্যক্তিত্বের গঠনগত দুর্বলতা, বিষণ্নতা, এলকোহলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, সামাজিক পরিবেশগত সমস্যা, ঘুমের ব্যাঘাত, দীর্ঘদিনের কোনো শারীরিক সমস্যা, অতিরিক্ত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবণতা, অসহোযোগিতামূলক মনোভাব, পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেওয়ার অক্ষমতা, বিভিন্ন মানসিক রোগ।
হ পারিপার্শ্বিক কারণ
দ্ব পারিবারিক কলহ বা প্রতিনিয়ত অস্থিতিশীল, নেতিবাচক পরিবেশ।
দ্ব বাবা-মা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন ইত্যাদি আপনজনের সঙ্গে ভঙ্গুর সম্পর্ক।
দ্ব দৈনন্দিন কাজ বা কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাশিত কর্মফল বা সফলতা না আসা।
দ্ব যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়া।
দ্ব চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা।
\হ
হ সামাজিক কারণ:
দ্ব সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দুর্নীতি।
দ্ব সামাজিকভাবে গোঁড়ামি, অন্যায়, অনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দেওয়া।
দ্ব সামাজিক অবস্থানের নামে ভিত্তিহীন, সামঞ্জস্যহীন মানদন্ড দাঁড় করানো।
দ্ব সফলতা অর্জনের নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হিংসা ও অহংকার চর্চা করা।
দ্ব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারা।
হ নৈতিক অবক্ষয়:
দ্ব অভাব ও অর্থলোভ ইত্যাদির ফলে নৈতিকতা বিবর্জিত কাজে অংশগ্রহণ, মানসিক শান্তি হ্রাস ও তুচ্ছ ব্যাপারেও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা।
দ্ব হত্যা, গুম, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকান্ড রোধের বদলে বেড়ে চলা, অপরাধ করার পরিবেশ ও সরঞ্জাম ইত্যাদির সহজলভ্যতা।
দ্ব ধৈর্য, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস, নড়বড়ে ধর্মীয় বিশ্বাস, অপরাধের বা পরিস্থির গভীরতা অনুভব করতে না পারা, নিজের ভুল, অন্যায় উপলব্ধি করতে না পারা।
দ্ব মানুষ তার নীতি ও নৈতিকতা হারিয়ে ফেললে, তার আকাঙ্ক্ষিত কিছু অর্জনে ব্যর্থ হলে সে তা পাওয়ার জন্য যে কোনো ধরনের হিংস্রতা প্রকাশে পিছপা হয় না এবং রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
হ রাগের লক্ষণ ও উপসর্গ:
দ্ব ঘনঘন শ্বাস নেয়া, শ্বাস নিতে ব্যাঘাত ঘটা, প্যানিক এটাক বা অ্যাংজাইটি প্রবেম্স্ন বারবার অধিক হারে ভুগতে থাকা, হার্ট বিট বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যথার সম্মুখীন হওয়া।
দ্ব সব বিষয় বা ঘটনার নেতিবাচক দিকটি সারাক্ষণ আঁকড়ে ধরে রাখা।
দ্ব সামান্য বা তুচ্ছ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো।
দ্ব কারও ইতিবাচক ব্যবহার বা কাজেও বিরক্ত হওয়া।
দ্ব সারাক্ষণ নেতিবাচক চিন্তায় অস্থিরতা ও অস্বস্তিতে ভোগা।
দ্ব কোন গুরুত্বহীন বিষয়কে সহজভাবে নিতে না পারা এবং দীর্ঘসময় পার হওয়ার পরও তা ভুলতে না পারা, ভেতর ভেতর ক্ষোভ জমতে থাকা।
দ্ব খুবই দ্রম্নত প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন হওয়া (চুপ থাকা, কিছুক্ষণ বাদেই চিৎকার করা, হঠাৎ প্রচন্ড ও বিমর্ষ আবার হঠাৎ কর্মক্ষম হওয়া ইত্যাদি)।
রাগের ক্ষতিকর দিক সমূহ:
হ শারীরিক
দ্ব উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ সৃষ্টি হয়।
দ্ব হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি।
দ্ব মাইগ্রেনের সমস্যা বৃদ্ধি।
দ্ব খাবারে অরুচি, হজমে বিঘ্নতা।
দ্ব ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা।
দ্ব মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, সমস্যা সমাধান ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, স্নায়ু ড্যামেজ হয়ে যাওয়া।
দ্ব নাবাবিধ চর্মরোগ যেমন : ব্রন, একজিমা ইত্যাদি। হাইপার এসিডিটি, শরীরের বিভিন্ন জোড়ায় কারণ ছাড়া ব্যাথা অনুভূত হওয়া।
দ্ব স্থূলতা বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি।
হ মানসিক
দ্ব রাগের ফলে সহিংস আচরণ আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে বিরূপ করে তোলে। নিজেদেরও অন্যের দৃষ্টিতে নেতিবাচক করে তোলে।
দ্ব অন্যদের সহিংস আচরণ শিক্ষা দেয়।
দ্ব রাগ বা সহিংস আচরণের পর অনেক সময় আমরা নিজেরা হতাশ হয়ে পড়ি। নিজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
হ পারিবারিক:
দ্ব পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে বন্ধন দুর্বল হয়ে যায়।
দ্ব সবার কাছে মূল্য বা গুরুত্ব কমে যায়।
দ্ব ব্যক্তিত্ব হ্রাস পায়।
দ্ব বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য, সাপোর্ট পাওয়া যায় না।
দ্ব একাকিত্বে ভুগতে থাকা ইত্যাদি।
হ রাগ নিয়ন্ত্রণে করনীয় :
দ্ব গভীরভাবে প্রশ্বাস নিন এবং নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকুন : গভীরভাবে প্রশ্বাস নিয়ে তিন সেকেন্ড দম আটকিয়ে রেখে তারপর আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ছাড়ুন, দেখবেন এতে রাগ অনেকটা কমে যাবে।
দ্ব পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমান: প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। ঘুম ভালো হলে মেজাজ ভালো থাকবে।
দ্ব নিয়মিত ব্যায়াম করুন : প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা ব্যায়াম করুন। ব্যায়াম করলে মানসিক চাপ ও হতাশা দূর হয়। শারীরিক ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও এন্ডোরফিন নামক উপাদান নিঃসৃত হয়- যা সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
দ্ব উল্টো করে সংখ্যা গণনা শুরু করুন : যখন মনে হবে করো প্রতি আপনি রেগে যাচ্ছেন, তখন ১০০, ৯৯, ৯৮, ৯৭ ৃ এভাবে উল্টো করে সংখ্যা গণনা শুরু করুন। এতে আপনার রাগ কমে যাবে।
দ্ব মনোযোগ সরিয়ে নিন : মনোযোগ সরিয়ে অন্য কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। পছন্দের গান শুনন বা মজার মজার ভিডিও দেখুন।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, নীলফামারী সদর, নীলফামারী।