বছরে কমপক্ষে এক-দুইবার নাক বন্ধ হওয়া, নাক দিয়ে পানি পড়া, হাঁচি-কাশি ও চুলকানির মতো লক্ষণ দেখা যায় না এমন মানুষ খুব কমই দেখা যায়। এলার্জিজনিত কারণে নাকের ভেতরে প্রদাহ হয়ে এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে একে এলার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়।
এলার্জিক রাইনাইটিস কোনো মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে লক্ষণ প্রশমিতকরণ বা সিম্পটোম্যাটিক। লক্ষণ তেমন মারাত্মক না হলে সাধারণত বাড়িতেই নিজে নিজেই সেগুলোর চিকিৎসা করা যায়। তবে ঘরোয়া চিকিৎসায় কাজ না হলে কিংবা লক্ষণগুলো আরও প্রকট হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এলার্জিক রাইনাইটিসের কারণ
এলার্জিক রাইনাইটিস মূলত বিভিন্ন জিনিসের প্রতি এলার্জিক রিয়্যাকশন বা সংবেদনশীলতা। এলার্জির প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেহে "হিস্টামিন" নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। হিস্টামিন নাকের ভেতরের চামড়ায় প্রদাহ সৃষ্টি করে। তখন নাকের ভেতরে প্রচুর পরিমাণে শ্লেষ্মা জাতীয় পিচ্ছিল তরল পদার্থ তৈরি হয়। এরপর হাঁচি এবং নাক থেকে পানি পড়াসহ এলার্জিক রাইনাইটিসের বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। একেকজন মানুষের একেক জিনিসে এলার্জি হয়। জেনেটিক কারণেও এলার্জি হতে পারে।
সচরাচর যেসব জিনিসে এলার্জি হতে দেখা যায় তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে :
দ্ব ডাস্ট মাইট
পরাগ রেণু
গৃহপালিত পশু-পাখি
ছত্রাক
\হ কর্মক্ষেত্রের পরিবেশে থাকা নানান এলার্জিক উপাদান:
হ কাঠের গুঁড়া
হ আটা ও ময়দার গুঁড়া
হ ল্যাটেক্স বা বিশেষ ধরনের রাবারের গস্নাভস
উলেস্নখ্য, পরিবেশ দূষণগত কারণেও এলার্জি হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবারের সদস্যদের ধূমপানের অভ্যাস থাকলে কিংবা বাড়িতে ডাস্ট মাইট থাকলে সেখানে বেড়ে ওঠা শিশুদের এলার্জির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এলার্জিক রাইনাইটিসের লক্ষণসমূহ
এলার্জিক রাইনাইটিসের লক্ষণগুলো অনেকাংশেই সাধারণ সর্দি-কাশির মতো। লক্ষণগুলোর মধ্যে কমন হচ্ছে:
দ্ব হাঁচি-কাশি
দ্ব নাকের ভেতর চুলকানি অনুভূত হওয়া
দ্ব নাক থেকে পানি পড়া, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া অথবা সর্দি হওয়া।
সাধারণত এলার্জি আছে এমন কোনো জিনিসের সংস্পর্শে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসব লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে।
বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই লক্ষণসমূহ মৃদু হয়ে থাকে এবং কার্যকর চিকিৎসায় তা সহজেই সেরে যায়। তবে কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণসমূহ তীব্র হয় এবং কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে কষ্টময় করে তোলে এবং নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যেমন, ঘুমের সমস্যা হওয়া।
ব্যক্তি বিশেষে লক্ষণ প্রকাশের সময়কাল ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেমন: কারও কারও নির্দিষ্ট ঋতুতে এলার্জিক রাইনাইটিস দেখা দেয়, কারণ তাদের ঋতুভিত্তিক গাছ ও ঘাসের পরাগে এলার্জি থাকে এবং ঋতু পরিবর্তনের সাথে লক্ষণগুলোও দূর হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ প্রায় সারা বছরই এই সমস্যায় ভুগতে থাকেন।
এলার্জিক রাইনাইটিসের সাধারণ চিকিৎসা:
এলার্জিক রাইনাইটিসের লক্ষণগুলো মৃদু হলে ঘরোয়াভাবেই তার চিকিৎসা করা যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো নাক বন্ধ, নাক দিয়ে পানি পড়া, হাঁচি-কাশি ইত্যাদি লক্ষণগুলো উপশম করা। এলার্জিক রাইনাইটিস উপশমে ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো হলো:
এলার্জি উদ্রেককারী জিনিসগুলো এড়িয়ে চলা।
অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ সেবন করা যা দেহে এলার্জির প্রতিক্রিয়ায় বৃদ্ধি পাওয়া হিস্টামিন এর বিরুদ্ধে কাজ করে। উলেস্নখ্য, একেকজনের ক্ষেত্রে একেক ধরনের অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ ভালো কাজ করে।
নরমাল স্যালাইন বা ০.৯ % সোডিয়াম ক্লোরাইড সমৃদ্ধ নাকের ড্রপ দিয়ে নাক পরিষ্কার করতে হবে। এটি নাকে থাকা এলার্জি উদ্রেককারী পদার্থগুলোকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
এলার্জিক রাইনাইটিসের জটিলতা
এলার্জিক রাইনাইটিস থেকে বেশকিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে। নাক দিয়ে পানি পড়া ও নাক বন্ধের সমস্যা থেকেও কিছু সমস্যা হতে পারে। যেমন:
দ্ব ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতা
দ্ব দিনের বেলা ঘুম ঘুম লাগা
দ্ব জ্বর ও মাথা ব্যথা হওয়া
দ্ব মেজাজ খিটখিটে হওয়া
কাজে মনোযোগ দিতে সমস্যা হওয়া
উলেস্নখ্য, রোগী এলার্জিক রাইনাইটিসের পাশাপাশি এজমা বা হাঁপানিতে ভুগলে হাঁপানির লক্ষণগুলো আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
এলার্জিক রাইনাইটিসে নাকের প্রদাহের ফলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন:
নাকের পলিপ
সাইনুসাইটিস
কানের ভেতরে ইনফেকশন
এলার্জিক রাইনাইটিস প্রতিরোধে করনীয়
এলার্জিক রাইনাইটিস প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এলার্জি উদ্রেক করে বা করতে পারে এমন জিনিসগুল এড়িয়ে চলা। এলার্জি উদ্রেককারী জিনিসগুলো পুরোপুরি এড়িয়ে চলা কঠিন হতে পারে। যেমন- বাড়িতে ডাস্ট মাইট আছে কি-না সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া বেশ কঠিন। কারণ অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাসাবাড়িতেও এগুলো থাকতে করতে পারে। আবার নিজের কিংবা কোনো নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে পোষা প্রাণী থাকলে সেগুলোর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলাটাও কঠিন। তবে এলার্জি উদ্রেককারী জিনিসের সংস্পর্শ যথাসম্ভব কমিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এগুলো এলার্জিক রাইনাইটিসের লক্ষণ উপশমে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কমন এলার্জিক উপাদানগুলো এড়িয়ে চলার কিছু কার্যকর উপায় তুলে ধরা হলো:
\হ
ডাস্ট মাইট
ডাস্ট মাইট নামের ছোটো ছোটো কীটপতঙ্গ এলার্জি উদ্রেকের সবচেয়ে বড় কারণগুলোর মধ্যে একটি। এরা বাসায় থাকা ধুলাবালিতে বংশবিস্তার করে। আকারে খুব ছোট হওয়ায় এগুলোকে খালি চোখে দেখা যায় না। তাই শনাক্ত করাও বেশ কঠিন।
ডাস্ট মাইট থেকে এলার্জি প্রতিরোধে যা মেনে চলা উচিত:
দ্ব বিছানার চাদর, কাঁথা, পর্দা, ছোট বাচ্চাদের নরম খেলনা, বালিশ ও লেপের কভার সপ্তাহে অন্তত একবার গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
দ্ব বাড়িতে ব্যবহৃত যেসব জিনিস সহজে ধোয়া যায় না সেগুলো বাসায় যত কম ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো। যেমন: কার্পেট ও উলের কম্বল। কার্পেটের পরিবর্তে শক্ত ভিনাইল এর ফ্লোরম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে। কম্বলের ক্ষেত্রে সহজে ধুইয়ে দেওয়া যায় এমন সিনথেটিক কাপড়ের কাভার ব্যবহার করা যেতে পারে।
দ্ব বাড়ির যে জায়গাগুলোতে বেশি সময় কাটানো হয় যেমন, বসার ও শোয়ার ঘর সবসময় ধুলামুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
দ্ব বিছানা গোছানো ও ঝাড়া-মোছা করার সময়ে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
দ্ব যেসব জিনিস ভেজা কাপড় দিয়ে মোছা যায় যেমন- বাড়ির মেঝে ও আসবাবপত্র সেগুলো ভেজা কাপড় দিয়েই মুছতে হবে। এতে ধুলোবালি বাতাসে কম উড়বে, ছড়িয়ে যাবে না।
দ্ব যারা বাড়িতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করেন সম্ভব হলে 'হেপা ফিল্টার' যুক্ত ক্লিনার ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো ধুলাবালি দূর করতে অধিক কার্যকর।
পোষা প্রাণী
অনেকেই মনে করেন পশু-পাখির পালক বা পশমে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হয়। এটি একটি ভুল ধারণা। মূলত পশু-পাখির শরীর থেকে ঝরে পড়া মৃত কোষ, মুখের লালা ও শুষ্ক প্রস্রাবের কণা এলার্জি উদ্রেক করে।
এলার্জিক রাইনাইটিসের সমস্যা থাকলে পোষা প্রাণী এড়িয়ে চলাই ভালো। সেটি সম্ভব না হলে যা করা যেতে পারে:
দ্ব পোষা প্রাণীকে যথাসম্ভব বাড়ির বাইরে রাখতে হবে। বাইরে লালন-পালন করা সম্ভব না হলে বাড়িতে একটি আলাদা ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেখানে কার্পেট ব্যবহার করা যাবে না।
দ্ব বেডরুমে পোষা প্রাণীকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
দ্ব পোষা প্রাণীকে সপ্তাহে অন্তত একবার ভালো করে গোসল করাতে হবে।
দ্ব পোষা বিড়াল কিংবা কুকুরকে নিয়মিত বাড়ির বাইরে নিয়ে পশম আঁচড়ানো, ব্রাশ করানোসহ ত্বকের সার্বিক যত্ন নিতে হবে।
দ্ব পশু-পাখির ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়মিত ধুয়ে দিতে হবে।
পরাগ রেণু বা পোলেন
একেক ধরনের গাছপালার পরাগায়ন বছরের একেক সময়ে হয়। তাই বছরের কোন সময়ে এলার্জিক রাইনাইটিসের প্রকোপ বাড়বে সেটি কোন ধরনের পরাগে এলার্জি আছে তার ওপর নির্ভর করে। তবে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে বাতাসে পরাগ রেণুর পরিমাণ বেড়ে যায় বলে সাধারণত এ সময়েই বেশিরভাগ মানুষকে এলার্জিক রাইনাইটিসে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এ সময় যা মেনে চলা উচিত:
দ্ব ঋতু পরিবর্তনের সময়ে, বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে যতটা সম্ভব ঘরের ভেতরে থাকতে হবে।
দ্ব সকালে এবং সন্ধ্যার আগে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হবে। এই সময়ে বাতাসে পরাগরেণুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি থাকে।
দ্ব বাতাসে পরাগ রেণুর পরিমাণ বাড়লে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়াই ভালো। আর যদি বাইরে জেতেই হয় সেক্ষেত্রে বাড়িতে ফেরার পর গোসল করে নিতে হবে বাইরে পরে যাওয়া জামা-কাপড়গুলো ধুয়ে ফেলতে হবে।
দ্ব সম্ভব হলে জামা-কাপড় ঘরের ভেতরে শুকাতে হবে। তবে বাড়িতে যেন ছত্রাক না জন্মায় সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
দ্ব যেসব জায়গায় ঘাসের পরিমাণ বেশি সেখানে হাঁটাচলা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ছত্রাক
উষ্ণ ও সঁ্যাতসেঁতে পরিবেশ এ ধরনের এলার্জির উপদ্রব বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি প্রতিরোধে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে:
দ্ব বাড়ির পরিবেশকে শুষ্ক রাখার পাশাপাশি আলো-বাতাস চলাচলের ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে।
দ্ব বাড়ির ভেতরের সঁ্যাতসেঁতে ও আর্দ্র স্থানগুলো মেরামত করে নিতে হবে।
দ্ব গোসল ও রান্নার সময়ে জানালা খুলে দিতে হবে। তবে এ সময়ে রান্নাঘর ও বাথরুমের দরজা বন্ধ রাখতে হবে যেন বাষ্প বাড়ির ভেতর না ঢুকে। তাছাড়া বাষ্প বাড়ির বাইরে বের করে দিতে এক্সাস্ট ফ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে।
দ্ব বাড়ির ভেতরে ভেজা কাপড় শুকোতে দেওয়া যাবে না। সঁ্যাতসেঁতে স্থানে কাপড় রাখা ও আলমারিতে একই স্থানে অনেক কাপড় গাদাগাদি করে রাখা যাবে না।
দ্ব ঘরে গাছ রাখা যাবে না।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
নীলফামারী সদর, নীলফামারী।