রূপবৈচিত্র্যে ভরপুর হেমন্ত
প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মোখতারুল ইসলাম মিলন
বা ংলাদেশের ছয় ঋতুর মধ্যে হেমন্তকাল এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে দেখা মিলে হেমন্ত নামক ঋতুর। শরৎ ও শীতের মধ্যবর্তী এই ঋতু ইংরেজি মাসের অক্টোবরের শেষ থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং নতুন ফুল-ফল নিয়ে হেমন্তকাল প্রকৃতির এক মনোমুগ্ধকর সময়। এই ঋতুতে বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন ফসলের মাঠ, নদীর ধারে কুয়াশার চাদর এবং প্রকৃতির রূপভরা পরিবেশ বিশেষভাবে ফুটে ওঠে।
হেমন্তের প্রকৃতি যেন এক স্বপ্নিল মায়াজাল তৈরি করে। এ সময় ধানক্ষেতগুলো পেকে উঠে সোনালি রঙে মিশে যায়। কৃষকরা তাদের ফসল কাটার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মেঠো পথ ধরে চলে ধান কাটার দৃশ্য। এছাড়াও, ছোট ছোট নদী ও খাল-বিলগুলোতে পানির স্তর কিছুটা কমে আসে- যা স্থানীয় জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। গাছের পাতা শুকাতে শুরু করে, নতুন মুকুল ও ফল ধরতে থাকে। হেমন্তের প্রকৃতি নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন- 'হেমন্তের কুয়াশা ভরা মাঠে, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ, মন ভরে ওঠে প্রাণে, যেন নতুন জীবনের গান।'
আবহাওয়ার দিক থেকে হেমন্তকাল এক স্বস্তিদায়ক সময়। এ সময় দিনের তাপমাত্রা কমতে থাকে, আর রাতের কুয়াশা কিছুটা ঠান্ডার আমেজ নিয়ে আসে। গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকে না, কিন্তু শীতের কনকনে ঠান্ডাও এখনো পুরোপুরি আসে না। হালকা শীতল বাতাস আর রোদের মিশ্রণে পরিবেশটা বেশ মিষ্টি হয়ে থাকে। মানুষের পোশাকেও কিছুটা পরিবর্তন আসে; হালকা গরম কাপড় পড়তে শুরু করে অনেকে।
হেমন্তকালে বেশ কিছু বিশেষ ফুল ফুটে থাকে- যা এই ঋতুর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য ফুল হলো কাশফুল। কাশফুলের দোলা আর সাদা পাপড়ির কোমলতা হেমন্তের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মাঠের ধারে ধারে কাশবন সাদা চাদরের মতো ঢেকে যায়। এছাড়া ধানক্ষেতে সূর্যমুখী ফুল এবং অন্যান্য শস্যফুলও চোখে পড়ে। এছাড়াও আরো যেসব ফুলের দেখা মিলে- শিউলি, বকুল, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়া, ডালিয়া, সূর্যমুখী ইত্যাদি। হেমন্তকালের ফুল প্রকৃতির সৃজনশীলতাকে আরো উজ্জ্বল করে তোলে।
নবান্ন উৎসবের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হেমন্তকাল। এই ঋতুতে নতুন ধান ওঠে, আর সেই ধান থেকে তৈরি হয় পিঠা-পায়েস। ধান কাটার পর চাল থেকে চিড়া, মুড়ি, ও পিঠা তৈরি করা হয়। নতুন চালের ঘ্রাণ আর এই খাদ্যসামগ্রী উৎসবের এক নতুন আমেজ তৈরি করে। এছাড়া, এ সময় আমলকী ও জলপাই ফল পেকে ওঠে। জলপাই দিয়ে আচার তৈরি করা হয়- যা হেমন্তের বিশেষ এক স্বাদ হিসেবে পরিচিত।
হেমন্তে বাংলার কৃষিজীবী সমাজ নবান্ন উৎসব পালন করে। নবান্ন মানে নতুন ধান কাটা ও তা থেকে খাদ্য তৈরি করে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা। এটি শুধু কৃষির উৎসব নয়, গ্রামীণ জীবনযাত্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এ সময় গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়, আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে নতুন ফসলের আগমনের আনন্দ উদযাপন করে।
হেমন্তকাল প্রাকৃতিক রূপ ও কৃষিভিত্তিক জীবনের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। এই ঋতুতে প্রকৃতি যেমন নতুন রূপে সেজে ওঠে, তেমনই মানুষের জীবনেও আসে পরিবর্তন ও সমৃদ্ধি। হেমন্তের ফুল, ফল, আবহাওয়া, আর উৎসবগুলো সব মিলিয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার এক বিশেষ প্রতিচ্ছবি।