রিমিদের বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ের একটি পেয়ারা গাছে অনেক পেয়ারা ধরেছে। শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভেজা ডাউস পেয়ারাগুলোর হলুদাভ চকচকে রূপ দেখে রিমির খুব লোভ জাগে। সে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে দেখতে পায় একটি লেজঝোপা কাঠবিড়ালি গাছের শাখায় দুলে দুলে মনের আনন্দে পেয়ারা খাচ্ছে। কুটুসকাটুস করে একটু আধটু খেয়ে বাকি উচ্ছিষ্ট টুকু পুকুরে ছুড়ে মেরে মাছকে দিচ্ছে। এতে করে কিছু মাছ খুব রেগে যায়- কারণ তারা ভালো এবং পাকনা পেয়ারা না দিলে খাবে না। কাঠবিড়ালি তাদের ভালো পেয়ারা দেয় না বলে তারা রেগে যায়।
পরবর্তী এক সময় পেয়ারা খেতে গিয়ে এক কাঠবিড়ালির ছানা পুকুরে পড়ে যায়। কী ভয়ানক কান্ড! সব মাছ মিলে কাঠবিড়ালির ছানাকে যখন কামড়ে মেরে ফেলতে যায় ঠিক তখন কাঠবিড়ালির সঙ্গে মাছের একটা সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তমতে কাঠবিড়ালি যদি আজীবন পুকুরের সব মাছকে ভালো এবং পাকনা পেয়ারা দেয় তবেই তার এই ছানাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কাঠবিড়ালি তা মেনে নেয় এবং সব মাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতে। এই চুক্তি করার সময় বানর ছিল প্রধান সমন্বয়কারী আর বুদ্ধিটা বের হয়েছিল রিমি মণির মাথা থেকে- তাই কাঠবিড়ালি রিমি আর বানরের সঙ্গেও ভালো পেয়ারা খাওয়ানোর ওয়াদা করেছিল।
কিন্তু সেদিন সকালে রিমি মণি যখন কাঠবিড়ালির কাছে একটি ভালো পেয়ারা আবদার করে, দুষ্ট কাঠবিড়ালি এতে রাজি না হয়ে বরং ভেঙচি কেটে রিমি মণিকে তিরস্কার করছিল, ঠিক এভাবে-
দুষ্ট রিমি, রাগ করেছ?
মারবে ছুড়ে ঢিল?
এসব কাজে তোমার সঙ্গে
বানরগুলোর মিল।
বানর দূর থেকে কাঠবিড়ালির এমন ছড়া শুনে তেড়ে আসে, সেও ছড়ায় ছড়ায় উচিত জবাব দিয়ে দেয়-
দুষ্টু চোঁ-চাঁ, নাক বোঁচা তুই
খুব বেড়েছিস দেখি
সব কথা তোর মিথ্যা কথা
কাজ করিস সব মেকি!
কাঠবিড়ালি বানরের কথা শুনে হাসে, বানর আর রিমি মণিকে উপহাস করে বলে, এখন থেকে তোমাদের আর কোনো সহায়তা লাগবে না, আমার অথবা আমার পুচকো বাচ্চাদের পুকুরে পড়ে কোনো সমস্যা হলে মাছেরাই বাঁচাবে। সুতরাং, তোমাদের আমি পেয়ারা দিতে পারব না। এতে করে বানর আর রিমি কাঠবিড়ালির ওপর খুব রেগে যায়। তারা কাঠবিড়ালিকে শাস্তি দেওয়ার ফন্দি আঁটে। বানর রিমিকে বলে,
-রিমি মণি, তুমি আমাকে একটা কাজে সাহায্য করতে পারবে?
-কি কাজ? বল দেখি।
-৮/১০ টুকরো মুখ দেখার ভাঙা আয়নার টুকরো জোগাড় করতে পারবে?
-অবশ্যই, কিন্তু আয়নার টুকরো দিয়ে কি করবে?
-রিমি একটা মোটাসোটা কাগজের ঢাল নেবে তাতে আঠা দিয়ে আয়নার টুকরোগুলোকে পাশাপাশি বসাবে। শক্ত হয়ে লেগে গেলে সামনে দাঁড়িয়ে তাতে নিজের চেহারা দেখবে।
যেমন পরামর্শ তেমন কাজ, পরের দিন রিমি তেমনই একটা জিনিস বানিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে দেখে, আয়নার যতটা টুকরো আছে ততটা রিমিকে ওখানে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রিমি তখনো বুঝে উঠতে পারেনি, বানর এটা দিয়ে কী করবে। বানরকে ডেকে দেখায়। বানর রিমি মণিকে ধন্যবাদ জানায় আর বলে,
-বুঝছো রিমি, আজ বিকালে কাঠবিড়ালি যখন তার বাচ্চাদের নিয়ে পেয়ারা খেতে উঠবে ঠিক তখন আমি তোমার বানানো আয়না নিয়ে গাছে উঠবো। খুব জোরে জোরে গাছের ডাল নাড়া দেব যেন বাচ্চা সহ কাঠবিড়ালি পানিতে পড়ে যায়।
-তার পর তার পর...?
-তার পরও এরা যদি পুকুর পাড়ে উঠতে চেষ্টা করে তুমি লাঠি পেটা করে আবার পানিতে ঠেলে দেবে, যেন উঠতে না পারে।
-এরা তো উঠতে চায়বে না, এদের তো মাছেরা বাঁচতে সাহায্য করবে।
-ওটা আমি দেখব। আমি কী করি, তখন তুমি দেখে নিও।
-ঠিক আছে।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসে আসে, কাঠবিড়ালি বাচ্চাদের নিয়ে মনের সুখে পেয়ারা খাচ্ছে আর পুকুরের মাছকেও দিচ্ছে। হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকুনি গাছের ডালে। ধুপধাপ করে পানিতে ছিটকে পড়ে কাঠবিড়ালিরা, তাদের চিৎকারে পুকুরের মাছেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের বাঁচানোর জন্য।
পেয়ারা গাছের শক্ত ডালে বসে বানর মাছদের ডেকে বলে, শোনো শান্তি প্রিয় মাছরা।
-তোমরা, কাঠবিড়ালিকে আর বাঁচাতে যেও না।
-কিন্তু কেন? কাঠবিড়ালিতো আমাদের ভালো ভালো পেয়ারা দেয়। তাছাড়া যে কারো বিপদে এগিয়ে আসাতো সবার উচিত।
-কারো বিপদে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসা ভালো- তবে যারা বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে উপকারীর উপকারের কথা ভুলে যায় তাদের একটা উচিত শিক্ষা দিয়ে পুনরায় একই কথা মনে করিয়ে দেওয়াও খুব প্রয়োজন বলে মনে করি আমি।
-না, আমরা অতসব বুঝি না, তোমার কথাতেও বলেছে উপকারীর উপকার করতে। আমরা ওদের বাঁচাবই।
- দাঁড়াও মাছরা, এই মুহূর্তে তোমাদের কাজ বন্ধ কর এবং সবাই আমার দিকে দেখ। তোমরা ভালো করে দেখ, আমি কৌশল করে ইতোমধ্যে পুকুর থেকে তোমাদের মতো অনেক মাছকে ধরে নিয়ে এসেছি। মাছরা সেই আয়নার ভেতরে দেখতে পায় ঠিকই কিছু মাছ বন্দি হয়ে আছে বানরের হাতে।
-আপনি এটা কীভাবে করলেন? দয়া করে আর করবেন না।
-আমি চাইলে তোমাদের সবাইকে একইভাবে ডাঙায় তুলে এনে মেরে ফেলতে পারি। তোমরা যদি আমার কথা না শোনো তাহলে তা-ই করব আমি।
-না না, আমরা যে যার ঘরে চলে যাচ্ছি। আমাদের আর ধরে ডাঙায় তোলো না, ওদেরও ছেড়ে দাও।
-ঠিক আছে, তাহলে তোমরা এখান থেকে যাও।
রিমি পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আর হাসছে। কাঠবিড়ালি পুকুরে ভেঙে পড়া শুকনো ভাসমান একটি কাঠের টুকরোয় তার ছানাগুলোকে নিয়ে জড়িয়ে বসে ভয়ে কাঁপছে। বানর দূর থেকে ডেকে বলছে,
-দেখেছিস্? মিথ্যাবাদী অকৃতজ্ঞদের কেমন শাস্তি পেতে হয়?
-আমাকে মাফ করে দাও, আর কখনো তোমাদের সঙ্গে এমন কাজ করব না।
রিমি কাঠবিড়ালির কাকুতি দেখে তার নিরীহ আদুরে বাচ্চাদের দিকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাঙায় তুলে আনে। বানরকে ধন্যবাদ দেয় অকৃতজ্ঞ কাঠবিড়ালিকে শাস্তি দিয়ে তার ভুল ভেঙে দেওয়ার জন্য।