এক যে আছে বন। বনের পাশেই রয়েছে এক ডোবা। পড়ন্ত বিকালে দাঁড়াশ, তুতুর, ঢোঁড়া, দুধরাজ, মেটে ও অন্যান্য সাপ বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
গাছের ডালে বসা লাউডগা সাপ সবাইকে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছো তোমরা?
সবাই সমস্বরে উত্তর দিল, ভালো আছি।
মেটে সাপ বলল, তুমিও নিচে নেমে এসো। একসঙ্গে আনন্দ-ফুর্তি করি সবাই।
লাউডগা সাপ বলল, ঠিক আছে। আসছি।
এদিকে ডোবার কচুরিপানার ঝোপের ভেতর থেকে একটা বড় সাইজের জলঢোঁড়া সাপ উঠে এসে মিষ্টি সুরে বলল, আমিও তোমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাই।
সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তাকে কেউ চিনতে পারছে না।
জলঢোঁড়া বলল, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি তো তোমাদেরই একজন। এত দিন ডোবায় থেকে ব্যাঙ, মাছ, পোকা-মাকড় ইত্যাদি খেয়ে দেহটাকে বানিয়েছি বেশ। তোমাদের সঙ্গে আড্ডা মারার সময় পাইনি।
দাঁড়াশ বলল, ঠিক আছে তাহলে। তুমিও আমাদের সঙ্গে যোগ দাও।
সবাই বেশ আনন্দ-ফুর্তি করে যার যার মতো করে বাড়ি ফিরে গেল।
পরের দিন সকাল বেলার ঘটনা। জলঢোঁড়াটি মেটে সাপকে একাকি সামনে পেয়ে বলল, এই তুই আমার জন্য একটা ইঁদুর ধরে আন। অনেক দিন ধরে ইঁদুর খাওয়া হয় না। না আনতে পারলে কিন্তু তোকেই গিলব। এ ব?্যাপারে কাউকে জানালে তোর খবর করে ছাড়ব।
মেটে সাপটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আপনি যা বলেন তা-ই হবে।
দু'দিন বাদেই ডোবার কাছে জলঢোঁড়াটি ঢোঁড়া সাপকে দেখে বলল, এই এদিকে আয়।
ঢোঁড়া বলল, কী হয়েছে ভাই?
জলঢোঁড়া ভয়ানক রূপ নিয়ে বলল, এত সাহস তোর! আমাকে ভাই বলিস। আজ থেকে বস বলবি আর আমি যা বলব তা-ই করবি। আরেকটা কথা, জবান খুললে কিন্তু তোর-ই জবান বন্ধ করে দেব। এখন যা, আমার জন্য জ?্যান্ত তাজা মাছ ও ব্যাঙ ধরে নিয়ে আয়।
ঢোঁড়া ভয়ে ভয়ে বলল, ঠিক আছে বস। যাচ্ছি, আর আপনার কথা মতোই চলব এখন থেকে।
আরেক দিনের ঘটনা। দুধরাজ সাপ সামনে পড়লে জলঢোঁড়া বলল, এই দুধরাজ শোন। আমার জন্য কিছু দুধ নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।
দুধরাজ বলল, তোমার আচরণ এত রূঢ় কেন
জলঢোঁড়া বলল, বেশি পাকনামি করবি না। তাহলে তোর ও তোর পরিবারের সবার জীবন কেড়ে নেব।
দুধরাজ আতঙ্কিত হয়ে গেল আর বলল, ঠিক আছে হুজুর। আপনার আদেশ দ্রম্নত তামিল করছি।
এবার একদিন দুপুর বেলায় সামনে পড়ল দাঁড়াশ সাপ। জলঢোঁড়া দাঁড়াশকে দেখেই বলল, কোথায় যাচ্ছিস
জলঢোঁড়ার ব্যবহারে দাঁড়াশ হতবাক হয়ে উত্তর দিল, এই একটু সামনেই যাচ্ছি।
জলঢোঁড়া বলল, ঠিক আছে যা। আর ফেরার সময় আমার জন্য কচি মুরগির বাচ্চা ধরে আনবি। একটা কথা ভালোভাবে শুনে রাখ, সবাইকে নিয়ে আমার কথামতো চলবি আজকে থেকে। নইলে কারোর-ই রেহাই নেই।
দাঁড়াশ বিষয়টি ঠান্ডা মাথায় হজম করে জলঢোঁড়ার সামনে থেকে বিদায় নিল।
সেদিনই রাতের বেলা দাঁড়াশ সবাইকে নিয়ে গোপনে বৈঠক করল। সবার মনে প্রচন্ড ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে নিজের জীবন গেলেও। যেই কথা, সেই কাজ। পরের দিন সকালবেলা জলঢোঁড়াকে একটা বটগাছের নিচে ঘুমন্ত অবস্থায় পেল। সবাই মিলে আক্রমণ করল। জলঢোঁড়াকে মারতে মারতে দেহ ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলল।
জলঢোঁড়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে এবারের মতো মাফ করে দাও।
সবাই বলল, তোর মতো অত্যাচারীর কোনো মাফ নেই।
আবার যখন সবাই মার শুরু করল, তখন জলঢোঁড়ার শরীর থেকে নকল আবরণ খসে পড়ল। অবাক কান্ড! এক সময় বন থেকে এক ভয়ানক অত্যাচারী যেই কেউটেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিল সবাই, সেই কেউটে সাপ-ই খোলস পাল্টিয়ে জলঢোঁড়ার রূপ ধারণ করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আবার তাদের দলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।