তুলতুলের বয়স নয় বছর ছয় মাস। তাতে কি! তার ভয়ে বাসার সবাই থাকে তটস্থ। সে ঘুম থেকে ওঠেই চিৎকার করে ডাকবে, 'শিউলি, এই শিউলি আমার ট্যাব নিয়ে আয়।' তারপর মুখ না ধুয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকবে আর ট্যাবের বাটন নাড়াচাড়া করবে। শিউলি ট্যাবের কিছুই বুঝে না। একবার ঘর পরিষ্কার করার সময় নেড়ে চেড়ে দেখছিল আর তাতেই তুলতুলের চিৎকার 'আমার ট্যাব ধরেছিস কেন? এটা আমার। আমার বাবা কিনে দিয়েছে। আমার জিনিস ধরলে তোর হাত ভেঙে দেব।' তারপর থেকে শিউলি ভুলেও তুলতুলের জিনিস ধরে না।
শিউলির বয়সও নয় বছর। তাকে দুই বছর আগে গ্রাম থেকে আনা হয়েছে তুলতুলের সঙ্গে থাকবে বলে। পাশাপাশি সে তুলতুলের কাজেও সাহায্য করবে। শিউলি বাবা-মা তুলতুলের দাদা বাড়ির পাশেই একটা ছোট্ট ঘরে থাকে। আনার সময় তুলতুলের বাবা বলেছিল, তাকে ঢাকার স্কুলে ভর্তি করে দেবে। কিন্তু তুলতুল চায় না বলে তা হয়নি। তুলতুল বলে, 'বাবা আমি তোমার মেয়ে আর শিউলি ওই পাশের নোংরা বাড়ির মেয়ে। তাই সে আমার কাজ করবে। আমি যখন স্কুলে যাব তখন সে আমার ঘর আমার খেলনা গুছিয়ে রাখবে।' তার বাবা তার সব অন্যায় মেনে নেন।
তুলতুলের মা তিনি আবার সভা সমিতি করেন। শিউলি দেখেছে প্রায় প্রতিদিন তাকে টিভিতে দেখায়। ম্যাডাম যখন মাইকে কথা বলেন তখন কি সুন্দর করে কথা বলেন। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে কেঁদেও ফেলেন। তিনি বাচ্চাদের জন্য একটা অফিস বানিয়েছেন সেখানে নাকি সব দরিদ্র আর কষ্টে থাকা বাচ্চাদের সব সমস্যা সমাধান করা হয়।
অথচ জলি ম্যাডাম বাসায় এসেই বলে এই শিউলি এদিকে আয়। আমার পা টিপে দে। নয়তো বলবে আমার মাথা টিপে দে। শিউলির এক সময় হাত ব্যথা করতে থাকে তাও সে কাজ করতে থাকে। সে যদি থেমে যায় তবে তাকে অনেক শাস্তি পেতে হবে। তাই ভয়ে সে কিছু বলে না।
তুলতুল ঠিক তার মায়ের মতো করেই কথা বলে। সেদিন বলল, 'এই শিউলি, এই ফকিরন্নি আমার মাথার ব্যান্ড কই? শিউলি কিচ্ছু বলতে পারে না। সে রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে একদিন সে পালিয়ে তার মা-বাবার কাছে চলে যাবে।
শিউলির খুব বই পড়তে ইচ্ছে করে। তুলতুলের অনেক বই। সে কোনো বই ঠিক মতো পড়েই দেখে না। কয়দিন ছবি দেখে পাতা উলটায় তারপর কলম দিয়ে আঁকা আঁকি করে কিছু পাতা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। শিউলি সেই বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তার থাকার যে ছোট জায়গা সেখানে রেখে দেয়। সে যখন গ্রামে ছিল তখন কিছুদিন স্কুলে পড়েছিল।
রাতের বেলা সে প্রতিদিন বই পড়ে। সে অনেক কিছু শিখেছে। সেদিন তুলতুলের শিক্ষক তাকে ডিকশনারি থেকে কীভাবে নতুন শব্দের অর্থ খুঁজে নিতে হয় শিখিয়েছে। শিউলি মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। তুলতুলকে শিক্ষক প্রতিদিন ১০টা নতুন শব্দ লিখতে বলেছে ডিকশনারি থেকে খুঁজে নিয়ে। তুলতুল অনেক বিরক্ত। সে শিউলিকে বলে,? 'তুই খুঁজে বের কর।' শিউলির মনে আর আনন্দ ধরে না। সে তাই প্রতিদিন ডিকশনারি থেকে শব্দ খুঁজে দেয় তুলতুলকে। এটা তার কাছে মজার খেলা।
সেইদিন তুলতুল স্কুল থেকে একটা চিঠি নিয়ে এসেছে। তাতে লেখা ৭ থেকে ১০ বছর বয়সি সবাই একটা রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। তারা দুইশ' শব্দের রচনা লিখে জমা দেবে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মানে বড় হয়ে কি হতে চায় সে বিষয়ে লিখবে।
তুলতুল লিখতে বসল। সে প্রথমেই লিখল, তার কি কি আছে- এই যেমন তার দুইটি গাড়ি আছে, তার বাবার অনেক টাকা আছে। সে বড় হয়ে অনেক দাসদাসি রাখবে, তারা তার সব কাজ করে দেবে। সে বাবার মতো হোটেল বানাবে। সেই হোটেলে তার জন্য আলাদা খাবার রান্না হবে। সে লিখে জমা দিল। তার মা অবশ্য বলেছে, 'তুলতুল আমার লক্ষ্ণী বাচ্চা, তুমি যাই লিখ না কেন আমি বলে দিয়েছি তুমিই প্রথম হবে।' তুলতুলের আর আনন্দ ধরে না।
সে রাতে স্বপ্ন দেখল তাকে প্রথম পুরস্কার দেয়া হচ্ছে, সাংবাদিকরা তার ছবি তুলছে।
এদিকে শিউলি ভাবছে সে কি করে লেখা জমা দেবে। সে তখন তুলতুলের ফেলে দেয়া পুরান খাতায় সুন্দর করে লিখল, 'সে বড় হয়ে একটা স্কুল তৈরি করবে, সেই স্কুলে বাচ্চারা যা করতে ভালোবাসে তাই করবে। কেউ জোর করে কিছু শেখাবে না। যদি কেউ চায় ছবি আঁকবে তবে তাই করবে। যদি কারও বাংলা পড়তে ভালো লাগে তবে তাই করবে, কেউ কবিতা লিখবে বা গান গাইবে, আর একটা কথা এই স্কুলের সব বাচ্চা সমান। এখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সে লিখে বাসার দারোয়ান চাচাকে দিয়ে খামে ভরে পাঠিয়ে দিল।
কিছুদিন পর সকাল বেলা বাসার গেটে অনেক সাংবাদিক এলো। তারা বলল, এই বাসায় যে বাচ্চাটি আছে সে প্রথম হয়েছে। তুলতুল তো লাফাতে লাফাতে নিচে নেমে এলো। সঙ্গে এলো তার দাম্ভিক বাবা-মা। দূরে দাঁড়িয়ে শিউলি সব দেখছিল। তুলতুলকে দেখে এক সাংবাদিক বলল, তুমিই বুঝি শিউলি? তুলতুল রেগে বলল, 'আমি শিউলি হব কেন? শিউলি আমার কাজের মেয়ে।'
সাংবাদিকদের চোখ পড়ল এবার শিউলির দিকে। তারা তাকে কাছে ডাকল। সবাই তখন শিউলির ছবি তুলছিল আর অনেক ফুল আর চকোলেট দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল। তুলতুল রেগে চিৎকার করে বলতে লাগল, 'এই মুহূর্তে তোরা বের হয়ে যা- আমার বাসায় তোরা অন্যকে পুরস্কার দিবি এত্ত সাহস। এটা আমার, আমি ছাড়া কেউ এই পুরস্কারের যোগ্য নয়।'
তুলতুলের মা তাড়াতাড়ি তার মুখ চেপে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তুলতুলের মা এবার শিউলির কাছে এসে বললেন, 'আমি একে নিজের মেয়ের মতো আদর যত্ন করে বড় করছি, পড়াশোনা শিখাচ্ছি তাই না শিউলি মামনি।'
শিউলি ঘুরে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, 'ম্যাডাম আমি যা শেখার নিজেই শিখেছি। গ্রামে থাকতে আমার মা আমাকে যে স্কুলে পড়িয়েছিল সেখানে শিখেছি। জলি ম্যাডাম রেগে বললেন, 'কি আবোল তাবোল বলছ, আসলে ওই যে আমার বিরুদ্ধে যে সংগঠন আছে না তারা মনে হয় মিথ্যে বলা শিখিয়েছে।'
শিউলি এবার ঘুরে বলল, 'জানেন, আমার মা-বাবাকে কথা দিয়েছিল আমাকে ম্যাডাম পড়াবেন তিনি কথা রাখেননি। আমাকে দিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করায়। আমি বাড়ি যেতে চাইলে তারা বলে আমার মা-বাবাকে তারা আর টাকা দেবে না। তাই তারা না খেয়ে মারা যাবে। অথচ আমি সারাদিন কাজ করি। এসব শুনে সবাই ছি ছি করতে লাগল। জলি ম্যাডামের বাচ্চাদের নিয়ে করা সংগঠনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল তিনি বাচ্চাদের জন্য কোনো ভালো কাজ না করে সব টাকা তার বিদেশের ব্যাংকে জমিয়েছেন। আর তিনি তার মেয়ের নামে অনেক হোটেল বানিয়েছেন। তার নাকি বিদেশে অনেক বাড়িও আছে।
সবাই মিলে শিউলিকে তার মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিল। তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিল। আর তুলতুলের কি হলো জান? তার মাকে তখন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। তারপরই তুলতুলকে বেয়াদবি আর স্বেচ্ছচারিতার জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হলো।