গল্প
আদরের চোখে একাত্তর
স্মৃতিসৌধ আপামর জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্মরণে নিবেদিত এবং শহীদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যেমন দেখো, এই যে, সিঁড়িসহ দীর্ঘ পথটা অতিক্রম করে আমরা এখানে আসলাম। এটাকে বুঝানো হয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসের সময়টাকে। এবার দেখো লাল ইটগুলো, এগুলো দ্বারা বুঝানো হয়েছে এ দেশের মানুষের রক্ত ঝড়ানো স্মৃতি।
প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মো. আব্দুর রহমান
স্বাধীনতা দিবস। সকালবেলা ঘুম ভাঙল আদরের। পর্দাটা সরিয়ে দেখল, ওর বাবা বেলকুনিতে চেয়ারে বসে বসে বই পড়ছে। ছোট্ট আদর কাছে গিয়ে বইটার নাম দেখার চেষ্টা করল। বইটার নাম- 'আগুনের পরশ মনি' আর লেখক- হুমায়ূন আহম্মেদ। এবার আদর বলল, 'বাবা এটা কি ভূতের গল্পের বই?'
বাবা মাথা নেড়ে বলল, 'না, বাবা এটা একটা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই।' আদর বলল, 'তাই না কি বাবা!'
হঠাৎ আদরের মনে পড়ল, আজতো স্বাধীনতা দিবস। ওদের বাসা ঢাকার অদূরে সাভারে। ওরা ফুটফুটে দুই ভাই, আদর এবং আদি। আদর ছোট্ট আর ওর ভাইয়া বড়। বাবার কাছে আবদারের শেষ থাকে না আদরের। তাইতো আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। ঘাড় ধরে চুমু খেয়ে বলল, 'বাবা চলো না আজ একটু স্মৃতি সৌধে যাই।' অবশেষে যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরিবারের সবাই মিলে চললো স্মৃতি সৌধে।
স্মৃতিসৌধে আজ অবশ্য অনেক ভিড়। বাবার হাতটি ধরে হাঁটছে আদর, সঙ্গে ওর ভাইয়াও আছে। আদর এবার স্মৃতি সৌধটা দেখে জানতে চাইলো, 'বাবা এটার কেন সাতটি মাথা?'
বাবা বলল, 'না বাবা, এভাবে বলে না। এটাকে বলা হয় সাতটি স্তম্ভ। এটা আমাদের বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভ। এই সাতটি স্তম্ভেরও ধারাবাহিক ইতিহাস আছে।'
আদর বলল, 'ও মা, তাই বাবা! আমি তো সেটা জানতাম না।' আর আদি বলল, 'বাবা ইতিহাসটা একটু বল না...।'
ওদের বাবা বলল, 'তাহলে শুনো। এই যে ছোট্ট যেই প্রথম ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভটা দেখতে পারছো, এটা হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলনকে বুঝায়। আর দ্বিতীয়টা দ্বারা বুঝায়- ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, তেমনিভাবেই তৃতীয়টায়-১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র গঠন, চতুর্থটায়-১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, পঞ্চমটায়-১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ছয় নম্বরটা দিয়ে বুঝায়-১৯৬৯ সত্তরের গণ-অভু্যত্থান।'
এবার আদি বলল, 'আর সাত নম্বরটা নিশ্চয়ই বাবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ?'
ওর বাবাও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লো এবং বলল, 'ঠিক তাই।' এবার আদর হাঁটতে হাঁটতে বলল, 'বাবা দেখো! কী সুন্দর সিঁড়ি, লাল ইট আর ছোট পুকুর!'
জবাবে বাবা বলল, 'এসো বলছি, এগুলো প্রত্যেকটাই বেশ অর্থ বহন করে। এই স্মৃতিসৌধ আপামর জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্মরণে নিবেদিত এবং শহীদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যেমন দেখো, এই যে, সিঁড়িসহ দীর্ঘ পথটা অতিক্রম করে আমরা এখানে আসলাম। এটাকে বুঝানো হয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসের সময়টাকে। এবার দেখো লাল ইটগুলো, এগুলো দ্বারা বুঝানো হয়েছে এ দেশের মানুষের রক্ত ঝড়ানো স্মৃতি। আর দেখো ওই যে গণকবরগুলো দেখতে পারছো, ওগুলো অবশ্যই শহীদদের স্মরণ করিয়ে দেয়। আর এই জলাশয়টার কথা বলছো, এটা হচ্ছে এই দেশের মানুষ চোখ থেকে যে অশ্রম্ন ঝরেছে সেই কথাটা মনে করিয়ে দেয়।'
কথাগুলো বলে, 'ওর বাবা চোখের চশমাটা খুললো। তারপর রুমাল দিয়ে চোখের অশ্রম্ন মুছতে লাগল। আদর এবং আদির চোখগুলোও আজকে বাবার মুখে স্বাধীনতার ইতিহাস শুনে ছলছল করছে। ঠিক তখন ওর আম্মু পেছন থেকে এসে বলল, 'আমি এতক্ষণতো তোমাদেরই খুঁজছিলাম। আসলেও এই ফুলের তোরাটা আনতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেল। চলো আমরা এবার সবাই মিলে মহান স্বাধীনতা দিবসে সব শহীদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি।'
আদর এবার ওর বাবার হাতটি ধরে বলল, 'হঁ্যা, বাবা চলো। আজ আমার চোখে একাত্তরের যুদ্ধের পরিক্রমাটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা এত সুন্দর করে বলার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবশ্যই আমাদের গৌরবের! তারপর ওরা সবাই মিলে এক সঙ্গে পুষ্পস্তবক অর্পণ করল।