যুদ্ধ ও হাওয়ার চিঠি
প্রকাশ | ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
রেবা হাবিব
হাওয়া খুব সুন্দর আর মিষ্টি একটি মেয়ে। তার বয়স পাঁচ বছর। বয়স কম হলে কী হবে, এমন বয়সেই সে বাংলা ভালো লিখতে ও পড়তে জানে। তার এক মাত্র বন্ধু ছোট মামাকে, প্রতি মাসে চিঠি লিখে পাঠায়। হাওয়ার বাবা নেই। মুক্তিবাহিনীতে ছিলেন। পাকবাহিনীর সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে বাবা মারা যান। মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই হাওয়া জানতে পারে যে, বাবা এখন মেঘের ওপারে আকাশে থাকে। ওপরে চিঠি পাঠানোর নাকি নিয়ম নেই। হাওয়া ভাবে, চিঠি পাঠানো যাবে। বুদ্ধি করে হাওয়া বড়সড় ঘুড়ি কিনে। চিঠি লিখে ঘুড়িটি আকাশে উড়িয়ে দেয়। ঘুড়ির উল্টো পিঠে বাবার জবাব আসবে। হাওয়া গুটি গুটি হাতে লিখল-
বাবা,
আমি তোমাকে খুব মিস করি। মা বলেন, তুমি আমাকে শেষবার যখন দেখেছিলে তখন আমার বয়স ছিল মাত্র চার বছর। এখন আমি বড় হয়েছি, আমিও স্কুলে যাচ্ছি। মা আমার চুলে দুইটি বেণি করে দেন। আমাকে স্কুলে দিয়েও আসেন। এখন আমি আমার মাকে বিরক্ত করি না, আমি বড় হয়েছি। আমার মা যা রান্না করেন, আমি নিজ হাতে চুপচাপ খাই। মা যখনই আমার দুইটি বেণি বানাতে থাকেন, তখনই মা তোমার সম্পর্কে অনেক কথা বলেন। তুমি আমাকে রাত জাগিয়ে রাখতে, আমাকে কোলে নিয়ে চাঁদনী রাতে রূপকথার গল্প শোনাতে। আমার একটুখানিই মনে পড়ে, তবু মায়ের কথায় রোজ তোমার কথা শুনি। কত দিন হলো তুমি চলে গেছ, কিন্তু প্রতিদিন তোমাকে মায়ের কাছ থেকে শুনি। যখনই মা আমাকে কোলে নিয়ে খাওয়ায়, তোমার কথা বলে। যেদিন তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে জীবনটা যেন কোথাও থেমে গেছে। আমার এখনো মাঝে মাঝে রাগ হয় যে, তুমি আমাদের এখানে একা রেখে চলে গেলে। মা বুঝতেও পারে না তুমি আমাদের থেকে দূরে। সে সারাদিন তোমার কথা বলে।
বাবা, এই মাসে আমার জন্মদিন, মনে আছে? আমার বন্ধুরা বলেছে, তুমি মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছ। তুমি কখনো আসবে না। কিন্তু বাবা, আমি নিশ্চিত তুমি আসবে। এই বছর আমার জন্মদিনে আমি মাকে তোমার উপহার দেব। মা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। আগে মা আমাকে ঘুমিয়ে রেখে বালিশে মাথা রেখে কাঁদতেন।
বাবা, আজও গ্রামের মোড়ে, মা ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন, যে পথে তুমি শেষবারের মতো চলে গিয়েছিলে। বাইরে থেকে কোনো খবর এলে মা ছুটে যান, তোমার খোঁজ নিতে।
বাবা, তুমি কি জানো তোমার সেই পুরনো জীর্ণ জামা, মা সামলে নিয়ে আলমারিতে রেখে দেয়। কখনো কখনো গোপনে বাইরে নিয়ে যায় আর বুকে জড়িয়ে নেয়। বাবা তুমি কি আমাদের নিয়ে ভাবো? তোমাকে চিঠি পাঠাই কয়েক মাস হয়ে গেল। আজও আমি তোমার আর তোমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করছি। জান বাবা, রাস্তার এক কোণে কাজি কাকার দোকান। সেই দোকান থেকে ঘুড়ি কিনে তোমাকে রোজ চিঠি পাঠাই। কাজি কাকা ঘুড়ির দাম নিতে চান না। আমাদের রাস্তার ও এলাকার মানুষ অনেক সম্মান করে। কিন্তু বাবা, আমার জন্মদিনে যত মানুষই থাকুক না কেন, তোমাকে খুব মনে করব। তুমি আমার কোলে না থাকা পর্যন্ত আমি আমার জন্মদিন পালন করব না।
বাবা, এখানে সবাই খুব ভালো। আমরা স্কুলে যাওয়ার পথে বের হলে রিকশাওয়ালা চাচা আমাদের রিকশায় নামাতে আসেন। মা টাকা দিলে বলেন, তোমার বাবা যখন দেশে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে পারেন, আমরা কি তার পরিবারের জন্য এতটুকু করতে পারি না? খুব ভালো মানুষ তাই না? দাদা মারা গেছেন অনেক আগেই, দাদিও কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মা খুব একা। কিন্তু তুমি চিন্তা কর না, তোমার মেয়ে তো আছে।
তুমি আমার সেরা বাবা। আমার জন্মদিনে তুমি আসবে না বাবা? আমি নিশ্চিত তুমি অবশ্যই আসবে। তুমি আমাদের জন্য চিন্তা করবে না। আমি এখন খুব খুশি, আমি বড় হয়েছি। আমি নিজের যত্ন নিতে পারি। বাবা, এই জন্মদিনে তোমাকে আসতেই হবে। মায়ের চোখে সেই দীপ্তি আর আনন্দ দেখার অপেক্ষায় আছি। তুমি কি আসবে বাবা? আমি অনেক বিড়ালছানা নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
ইতি,
তোমার আদরের হাওয়া।
চিঠি লিখে আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দিল হাওয়া। পৎ পৎ করে ঘুড়ি উড়ছে, উড়ে যাচ্ছে বাবার কাছে, মেঘমালা ঘেঁষে বেড়াচ্ছে। বাবা থাকেন মেঘের ওই ওপারে। হাওয়া খুশি হয়, উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা চিঠি পড়ছেন। এই বুঝি বাবা ঘুড়ির উল্টো পিঠে জবাব লিখেছেন- হাওয়া ভালো থাকো। দুষ্টুমি করো না। মায়ের কথা শোনো।
হাওয়া খিলখিল করে হাসে। চুলের বেণি দুলিয়ে হাসে। তার হাসিতে লাটাই ঘুড়িও যেন হেসে ওঠে।