বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
গল্প

নান্টু আর কাকের বিবাদ

কাক না থাকলে ঢাকা শহর খুব নোংরা থাকত। আমরা খুব অসচেতন সবাই যত্রতত্র ময়লা ফেলি। কাক তা খেয়ে জায়গা পরিষ্কার করে। তাই কাক খুব উপকারী পাখি।
হালিমা রিমা
  ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
নান্টু আর কাকের বিবাদ

'নান্টুু, এই নান্টু- এখনো ঘুমাচ্ছিস নাকি ব্যাটা, ওঠে পর ঝটপট।' ছোট চাচ্চুর এমন চেঁচামেচিতে নান্টু বিরক্তি নিয়ে ওপাশ ফিরে শোয়। মনে মনে ভাবে তার শীতকালীন ছুটির বারোটা বাজাতে চাচ্চু সকাল সকাল তার হোস্টেল থেকে চলে এসেছে। নান্টু আড়মোড়া ভেঙে অন্য পাশ ফিরে শুতে চাইলে দেখে চাচ্চু তার কম্বল ধরে টানাটানি করছেন। সে জানে তার আর ঘুমানো সম্ভব নয়।

সে জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে বলে, 'চাচ্চু, তোমার বিশ্ববিদ্যালয় কি বন্ধ?'

ছোট চাচ্চু হাসিমুখে বলে, 'হঁ্যা আমারও শীতকালীন ছুটি হয়ে গেছে। এই কয়দিন তুই আর আমি মিলে অনেক কাজ করব। তোকে অংক শিখাবো রোজ। আর তোর বাংলা বানানের যা ছিরি! এখন থেকে প্রতিদিন পাঁচটা নতুন বাংলা শব্দ লিখে দেখাবি আমাকে।'

চাচ্চুর এসব কথায় নান্টুর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। তার কপাল খুবই খারাপ; তা না হলে এমন পচা একটা চাচ্চু কিনা তারই ভাগ্যে জুটেছে। অথচ রিমন, জায়ান ওদের চাচ্চুরা কেউ সিঙ্গাপুর কেউ আমেরিকা থাকে। তারা এলে ওদের কত খেলনা আর মজার মজার চকোলেট কিনে দেয়। আর তারপর তারা সবাই মিলে তাদের চাচ্চুর সঙ্গে কক্সবাজার নয়তো সিলেটে বেড়াতে যায়। আর তার চাচ্চু এসেই শুরু করেন এইটা পড়; নয়তো ওইটা কর এসব। সে আরও ভাবে, ইশ বড়দের আর ছোটদের ছুটি যে কেন একই সময়ে হয়!

নান্টু সকালে চাচ্চুর সঙ্গে নাশতা খেয়ে নিল। আজ সে চুপচাপ খেয়ে নিল। যদি বলে, 'সবজি ভাজি খাব না' সে জানে চাচ্চু এত বকবক শুরু করবেন তার চাইতে খেয়ে নেয়াই শ্রেয়।

খেতে খেতে চাচ্চু গল্প করেন। তবে হঁ্যা চাচ্চু যত পচাই হোক; এত মজার মজার গল্প করে; তার শুনতে বেশ লাগে। এবার চাচ্চু পাখি বিষয়ে অনেক মজার কথা বললেন। নান্টুর প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এই যেমন একটা বড় গাছে এক হাজারের মতো চড়ুই পাখি বাস করতে পারে। আবার এরা জনবসতিপূর্ণ স্থানে থাকতে পছন্দ করে, তাই এদের ইংরাজি নাম হাউস স্প্যারো অর্থাৎ 'গৃহস্থালির চড়াই' এই পাখি বাড়ই, পিয়াইজ্জা ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

এবার চাচ্চু তাকে যা বলল- তা শুনে নান্টু খুব রোমাঞ্চিত হলো। কথাটি হলো চাচ্চু নাকি টিউশনির টাকা জমাচ্ছেন একটা ভালোমানের ক্যামেরা কেনার জন্য। ক্যামেরা কিনে তিনি নান্টুকে নিয়ে সাভারে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে যাবেন। সেখানে শীতে অনেক অতিথি পাখি আসে তারা দুজন মিলে পাখির ছবি তুলবে। চাচ্চুর কথায় সে খুব প্রফুলস্ন। বাহ! কত ই না মজা হবে।

বিকালে নান্টু বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যাবে বলে যেই না বের হলো কোথা থেকে এক কাক এসে তার মাথায় ইয়ে মানে হাগু করে দিয়ে পালাল। নান্টু আকাশের দিকে তাকিয়ে যত ইচ্ছা মনের দুখে কাককে দিল বকে। সে চিৎকার করে বলছিল, 'পচা, কুৎসিত কাক, তোমাদের গলা যেমন কর্কশ, তোমরা তেমনই নোংরা আর দুষ্ট।'

নান্টুর ব্যাডমিন্টন নিয়ে ফিরে আসা দেখে চাচ্চু অবাক হয়ে তাকালেন। তাকে দেখে যা বুঝার বুঝে গেলেন। তিনি নান্টুর কাকের উদ্দেশে নানা বাক্যবান দেখে একচোট হেসে নিলেন। শীতের বিকাল এমনিতেই অল্প সময়; তাই তার আর পরিষ্কার হয়ে খেলতে যাওয়া হলো না সেদিন।

রাতে চাচ্চু শুয়ে শুয়ে তাকে কাক নিয়ে তথ্য দিলেন। কাক দুই ধরনের পাতিকাক আর দাঁড়কাক। এদের মাঝে পাতিকাকের বুদ্ধি নাকি সবচাইতে বেশি। নান্টু বলে চাচ্চু এই পচা পাখিটার গল্প শুনব না। চাচ্চু হেসে বললেন, একটা পাখি না হয় একবার হাগু করে দিয়েছে- তাই এত রাগ করা মানায় নাকি?

পরের দিন চাচ্চুর সঙ্গে নান্টু কাছেই এক মাঠে মেলা হচ্ছে- সেখানে যাবে বলে খুশি মনে রওয়ানা হলো তার প্রিয় লাল শার্ট গায়ে দিয়ে। রিকশায় বসে কি যে মজা লাগছে তার। চাচ্চু তাকে এই ঠান্ডায় সে চাইতেই আইস্ক্রিমও কিনে দিয়েছে। সে চোখ বন্ধ করে আয়েশ করে চকবারে কামড় দিচ্ছিল। ঠিক তখন সে টের পেল তার মাথায় গরম কিছু। সে তাকাতেই দেখে তার কপাল বেয়ে কিছু একটা গড়িয়ে তার শার্টে পড়ল। সে ঘৃণায় চোখ মুখ বিকৃত করে চাচ্চু চাচ্চু বলে চিৎকার করে ভ্যা করে কান্নাজুড়ে দিল। তারা বাসা থেকে অনেক দূরে তাই এখন কিছু করার নেই। চাচ্চু এক বোতল পানি এনে তার মাথা আর কপাল ধুয়ে দিল। তারপর টিসু্য দিয়ে মুছে দিলেন। নান্টুর কান্না তাও থামছে না। চাচ্চু এবার গম্ভীর হয়ে বললেন পরপর দুদিন একই ঘটনা; এটা তো স্বাভাবিক নয়। নান্টু চোখ গোল করে শুনে। এবার চাচ্চু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি কাকের সঙ্গে ঝগড়া করেছ?'

\হনান্টু অবাক এ কেমন প্রশ্ন।

সে বলে, এটা আবার কি?

তিনি এবার স্পষ্ট করে বলেন, 'ধর তুমি কোনো কাকের বাসা ভেঙে দিয়েছ বা ঢিল ছুড়েছ?' এবার নান্টু মাথা চুল্কে ভাবতে লাগল। তার মনে পড়ে গেল হঁ্যা গত সপ্তাহেই তো সে আর সুমন মিলে স্কুলের মাঠে একটা কাকের বাসা ছিল আম গাছের মগডালে। তারা বাজি ধরে খেলছিল কার গুলতি কাকের বাসায় লাগে। সুমন একবারও পারেনি। কিন্তু সে তার গুলতি ঠিকই লাগাতে পেরেছিল। তার গুলতির ধাক্কায় তারস্বরে কাকগুলো আরও কর্কশভাবে ডাকছিল কা কা কা কা। তাদের তখন খুব হাসি পেয়েছিল।

এবার চাচ্চু সব শুনে বললেন, 'যা ভেবেছিলাম তাই। মা কাক তোমাকে চিনে রেখেছে। তুমি তার বাচ্চাদের ব্যথা দিয়েছ। তুমি জান, কাক তার শত্রম্নকে চিনে রাখতে পারে। কাকের চোখে তুমি তাদের মহাশত্রম্ন। তাই তোমাকে দেখলেই তারা শাস্তি দেবে।'

\হএসব শুনে নান্টু আরও জোরে কাঁদতে শুরু করে দিল।

এবার চাচ্চু বললেন, 'এখন থেকে ওয়াদা কর, আর কোনো দিন কোন নিরীহ পশুপাখির ক্ষতি বা তাদের বিরক্ত করবে না।'

\হনান্টু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

চাচ্চু বললেন, 'এখন থেকে কিছু দিন তুমি মাথায় টুপি পড়ে বা ছাতা নিয়ে বাইরে বের হবে। কিছুদিন পর কাক তোমাকে ভুলে যাবে। আর কোনো দিন তোমরা কেউ কাকের বাসার কাছেও যাবে না।

চাচ্চু বললেন, 'কাক যে কি উপকারী পাখি তা কি তুমি জান? কাক শহরের সব ময়লা আবর্জনা খেয়ে জায়গা পরিষ্কার রাখে। কাকের পছন্দ লোকালয়- কারণ, তারা আবর্জনা এই ধরো- মুরগীর নাড়িভুঁড়ি, পচা মাংস সব খায়। মানুষ বাসাবাড়ি থেকে যে পরিমাণ বর্জ্য এদিকে সেদিকে ফেলে বা ডাস্টবিনে রাখে তা খেয়ে ফেলে। কাক না থাকলে ঢাকা শহর খুব নোংরা থাকত। আমরা খুব অসচেতন সবাই যত্রতত্র ময়লা ফেলি। কাক তা খেয়ে জায়গা পরিষ্কার করে। তাই কাক খুব উপকারী পাখি। আর কাক আছে বলেই কোকিল পাখির বংশ বৃদ্ধি হয়।'

নান্টু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বলে- সেটা কেমন?

'কেন তুমি জান না কোকিল কাকের বাসায় তার ডিম পেড়ে আসে। আর কাক সেই ডিম নিজের ডিম মনে করে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায়। তাদের পরম যত্নে লালন করে। বসন্তকালে আমরা যে কোকিলের মিষ্টি ডাক শুনি তা কিন্তু কাক আছে বলেই সম্ভব।'

\হনান্টু মহাবিস্ময় নিয়ে চাচ্চুর সব কথা শুনছে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আর কোনো দিন কোন পাখি বা পশুকে সে বিরক্ত বা ক্ষতি করবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে