সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

ডায়ালাইসিস খরচ কমছে 'স্টেমসেল' পদ্ধতিতে

  ০১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
ডায়ালাইসিস খরচ কমছে 'স্টেমসেল' পদ্ধতিতে
রাজধানীর আফতাবনগরে বিএলসিএসে স্টেমসেল পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা -যাযাদি

জাহিদ হাসান

কিডনি রোগীদের ব্যয়বহুল ডায়ালাইসিস খরচ কমাতে ভূমিকা রাখছে নতুন চিকিৎসা স্টেম সেল পদ্ধতি। এতে করে আশার আলো দেখছেন কমবেশি কিডনি সমস্যায় ভোগা দেশের কমপক্ষে দুই কোটি রোগী। এ প্রেক্ষিতে রোগটির চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস নির্ভরতা কমাতে সরকারি হাসপাতালে সেবাটি চালুর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিন রাজধানীর আফতাব নগরে 'বাংলাদেশ লেজার অ্যান্ড সেল সার্জারি ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে (বিএলসিএস) স্টেম সেল পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিয়ে ডায়ালাইসিস সংখ্যা কমে যাওয়া একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে এর উপকারিতা সম্পর্কে জানা গেছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবা ব্যবস্থাটি ছড়িয়ে দিতে গবেষণা কার্যক্রম ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনি রোগীদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে প্রচুর অর্থ খরচ হয়। অনেক রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপনের সামর্থ্য থাকলেও কিডনি দাতা মেলে না। এক্ষেত্রে স্বল্প খরচে কিডনির কার্যকরিতা বাড়াতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিক আবিষ্কার হলো স্টেম সেল। এই পদ্ধতিতে রোগীর শরীরের অকেজো রক্তনালি সচল করা, ক্ষত সারানো, ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু পুনরুজ্জীবিত করা, স্বাস্থ্যকর নাইট্রিক অক্সাইড রিসেপটর ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এমনকি যেসব রোগীর সপ্তাহে তিন থেকে চারবার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়, স্টেম সেল চিকিৎসার এক পর্যায়ে তারা ডায়ালাইসিস ছাড়াই সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন।

গত দুই বছর ধরে মিরপুর ১১ নম্বর এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান স্বপন (৪৫) কিডনি রোগে ভুগছেন। অসুস্থ ছেলে সম্পর্কে তার বৃদ্ধা মা যায়যায়দিনকে বলেন, গত ৮ মাস ধরে ছেলেকে সপ্তাহে ৩টা করে ডায়ালাইসিস দিতে হচ্ছে। প্রতিবার ৩১০০ টাকা খরচ হয়। তখন বিএলসিএস হাসপাতালে স্টেম সেল চিকিৎসার কথা শুনে গত বছর এখানে আসেন। সে সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছেলের কিডনির কার্যক্ষমতা ৫ শতাংশ থাকায় চিকিৎসকরা এক বছর পরে আসতে বলেন। বর্তমানে কিডনির কার্যকরিতা আটে উন্নীত হওয়ায় স্টেম সেল দিতে এসেছেন।

একই এলাকার বাসিন্দা মাহমুদা বেগমের (৫২) দুই বছর আগে কিডনির সমস্যা ধরা পরে। পরীক্ষা করে দেখা যায় তার কিডনির জিএফআর (প্রতি মিনিটে কিডনির ভিতরের রক্ত পরিশোধিত হওয়ার মাত্রা বা কিডনির কার্যকর ক্ষমতা) ১৯ দশমিক ৫৮ এমএল-এ নেমে এসেছে। অথচ বয়স অনুপাতে জিএফআর মাত্রা ১০১ থাকার কথা। সমস্যা সমাধানে ডায়ালাইসিসের বিকল্প হিসেবে বিএলসিএস হাসপাতালে চালু হওয়া স্টেম সেল চিকিৎসার খোঁজ পান। চিকিৎসা নেওয়ার ছয় মাস পর পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় তার জিএফআর বৃদ্ধি পেয়ে ২১ দশমিক ৪৬ দাঁড়িয়েছে। পর্যায়ক্রমে ডায়ালাইসিসের সংখ্যা কমা ও কিডনি পরিস্থিতি উন্নীত হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে দ্বিতীয়বার স্টেম সেলের পরামর্শ দিয়েছেন।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম (৪৩) নামের আরেক রোগীর জিএফআর ছিল ১৩ দশমিক ২। বয়স অনুপাতে যেটি ৯৯ থাকার নিয়ম। একবার স্টেম সেল চিকিৎসা নিয়ে তার জিএফআর দ্বিগুণ হয়ে ২৬ দশমিক ২ হয়।

নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা জালাল সরকারের (৪৬) কিডনিতে প্রতি মিনিটে জিএফআর মাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৮ এমএল। বয়স অনুযায়ী এটি ১০৪ এমএল থাকতে হয়। এখানে চিকিৎসা ও নিয়মিত ডায়ালাইসিস করার ৬ মাস পর প্রতি মিনিটে তার শরীরের জিএফআর মাত্রা ২৮ দশমিক শূন্য এমএল দাঁড়িয়েছে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএলসিএস হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও স্টেম সেল বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী যায়যায়দিনকে বলেন, কিডনি অকেজো ব্যক্তিকে লোকাল অ্যানেসথেশিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে তার পেট, পিঠ বা উরুর চামড়ার নিচ থেকে সামান্য পরিমাণে চর্বি সংগ্রহ করা হয়। এরপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত শেষে স্টেম সেল পৃথকীকরণ ও সংগ্রহ করা হয়। সুপ্ত সেলকে উদ্দীপ্ত করে রোগীর আক্রান্ত অঙ্গে সরাসরি প্রতিস্থাপন করা হয়। এছাড়া শিরাপথে সঞ্চালনের মাধ্যমেও সারা শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এতে অকেজো কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে যেসব রোগীর এখনো ডায়ালাইসিস শুরু হয়নি স্টেম সেল প্রয়োগে তাদের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এমনকি স্টেম সেল দেওয়ার পর রোগীকে সপ্তাহ বা পনের দিন অন্তর একবার অথবা এক মাসে একবার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। একপর্যায়ে সেটিও কমে রোগী ডায়ালাইসিস ছাড়াই সুস্থ থাকতে পারেন।

হাসপাতালটির চিফ কনসালট্যান্ট ডা. জাহাঙ্গীর মোহাম্মাদ সারওয়ার যায়যায়দিনকে বলেন, এই পদ্ধতিতে আক্রান্ত ব্যক্তির কিডনির অচল কোষগুলো কর্মক্ষম হতে থাকে। পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াহীন হওয়ায় যাদের ডায়ালাইসিস শুরু হয়নি তাদের দেহে স্টেম সেলের কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি হয়। আর রোগীদের জিএফআর ৪০ থেকে ৫০ এর ঘরে পৌছালেই ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন অনুপাতে ডোজ (স্টেম সেল) নিলে একপর্যায়ে রোগী ডায়ালাইসিস ছাড়াই সুস্থ থাকতে পারেন। তবে কিডনির চিকিৎসায় এ পদ্ধতি শতভাগ সফল এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ উন্নত বিশ্বে এটি অনেক আগে চালু হলেও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন। এটির জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে আরও বেশি গবেষণা, বিশেজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

\হ

চিকিৎসা ব্যয়

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন কিডনির চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস, কিডনি প্রতিস্থাপন ও স্টেম সেল- এই তিনটির মধ্যে স্টেম সেল সবচয়ে বেশি কার্যকর। কারণ কিডনি প্রতিস্থাপন সঠিকভাবে না হওয়া ও দাতা সংগ্রহ না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার ডায়ালাইসিস মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুস্থ থাকা গেলেও কিডনির কার্যকরিতা বাড়ানো যায় না। পক্ষান্তরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় (ডোজ প্রয়োগ) স্টেম সেল চিকিৎসায় কিডনির কার্যক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। একপর্যায়ে ডায়ালাসিসও লাগে না। আর স্টেম সেল দেওয়ার পূর্বে রোগীর কিডনির কত ভাগ অকেজো হয়েছে সেটা নির্ধারণে ডিটিপিএ রেনোগ্রামসহ কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে হয়। সবমিলে স্টেম সেল চিকিৎসা দিতে প্রথমবার ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। ফলোআপে থাকা রোগীদের পরবর্তী চিকিৎসায় এ খরচ অর্ধেকে নেমে আসে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে