বদলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র। যানজট নিরসনে জাপান সরকারের অর্থায়নে জি টু জির ভিত্তিতে রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনকে ঘিরে পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার। আর সেটি হচ্ছে টোকিওর আদলে কমলাপুরে 'বহুমুখী স্টেশন' নির্মাণ।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান কমলাপুর রেল স্টেশন ভবনে একই ছাদের নিচে মেট্রোরেল স্টেশন, সিটি বাস স্টেশন, বাসর্ যাপিড ট্রানজিট স্টেশন নির্মাণ করা করা হবে এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ লিংক থাকবে। সদরঘাট লঞ্চ যাত্রীদেরও এই স্টেশনের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
সূত্রটি জানায়, জাপানের টোকিও স্টেশনের আদলে ১০ কোটি বর্গমিটার জায়গাজুড়ে এ সমন্বিত বহুমুখী স্টেশনটি নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। জাপানি কাজিমা করপোরেশনের পরিকল্পনা ও নকশায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। জাপান সরকারের অর্থায়নে প্রকল্পটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয় এবং কাজিমা করপোরেশনের সঙ্গে তিন দফায় বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ বৈঠকটি ছিল গত ৩০ মে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে সিটি বাস স্টেশন, ট্রেন স্টেশন, লঞ্চ স্টেশন আলাদা আলাদা জায়গায় হওয়ায় নগরের যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য রিকশা, বাস, বেবিট্যাক্সিসহ নানা যানবাহন ব্যবহার করতে হচ্ছে। আর তাতেই সড়কে ছোট যানবাহন বাড়ছে এবং যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ উন্নত বিশ্বে যাত্রীদের রেল স্টেশনেই নির্দিষ্ট গন্তব্যের যানবাহনের ব্যবস্থা আছে। সে আদলেই কমলাপুর রেল স্টেশনকে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে প্রকল্পটিতে।
রেল মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানায়, প্রকল্পটিতে বিদ্যমান রেল এবং কমলাপুর স্টেশনের মূল ভবনটি না ভেঙে তার চারপাশে ২৫তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। ভবনের তিনতলা পর্যন্ত থাকবে স্টেশন। হাইস্পিড ট্রেন স্টেশন থাকবে তৃতীয় তলায়। এ ছাড়া ভবনটিতে থাকবে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও বণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং পাঁচতারা হোটেল। থাকবে সব ধরনের বিনোদন কেন্দ্র। এছাড়া কমলাপুরের রেলের সব আবাসিক ভবন ভেঙে বহুতল আবাসিক ভবন করা হবে এবং খালি জায়গায় তৈরি করা হবে বাণিজ্যিক ভবন।
মেট্রো রেল ১ ও ৪-এর স্টেশন হবে কমলাপুর স্টেশনের পশ্চিম পাশের সড়কের নিচে (মাটির নিচে)। মেট্রো রেল ২-এর স্টেশন হবে কমলাপুর রেল স্টেশন-সংলগ্ন বিআরটিসি বাসডিপোর নিচে। চলমান মেট্রো রেল ৬-এর মতিঝিলের স্টেশনের সঙ্গে কমলাপুর রেল স্টেশনের যাত্রীদের পায়ে হেঁটে যাতায়াতের জন্য একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া কমলাপুর স্টেশনের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলার এক পাশে থাকবে সিটি বাস স্টেশন। পূর্ব পাশে থাকবে এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের সঙ্গে সংযোগ লিংক। ভবনের উত্তর-দক্ষিণ দিক দিয়ে থাকবে বাসর্ যাপিট ট্রানজিট (বিআরটি) স্টেশন। এমনভাবে প্রতিটি যানবাহনের স্টেশন ও যাতায়াতের পথ করা হচ্ছে যাতে এক যানবাহন চলাচলে আরেক বাহনের কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। যাত্রীরা রেল থেকে নেমে আরেক বাহনে ওঠার জন্য অন্য কোথাও যেতে না হয় সে ব্যবস্থা থাকছে।
জানা গেছে, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য গড়ে তোলা হবে দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল আবাসিক ভবন। বর্তমানে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবনগুলো সব চারতলা। প্রস্তাবিত প্রকল্পে আরেকটি ভবন হবে ২৫ তলা। এছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হাসপাতালকে আধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। কমলাপুর স্টেশনকে ঘিরে থাকবে বিনোদন কেন্দ্র। শুধু যাতায়াতের জন্য নয়, মানুষ যেন ঘুরতেও আসেন সে ব্যবস্থা থাকবে। তবে স্টেশনে ঢুকতে হলে অটোমেটিক মেশিনে টিকেট পান্স করে ঢুকতে হবে।
এ প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) ও রেলের পিপিপির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের যানজট ৮০ ভাগ কমে যাবে। কমবে যাত্রীদের ভোগান্তিও। কেননা এখন একজন যাত্রীকে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে মোহাম্মদপুর যেতে হলে বাস বা সিএনজি অটোরিকশা বা ট্যাক্সিতে উঠতে হয়। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ওই যাত্রী সিটি বাস, মেট্রো রেলসহ সব ধরনের যানবাহনে উঠতে পারবেন কমলাপুর রেল স্টেশন থেকেই। তাই তাকে ছোট যানবাহন ব্যবহার করে উঠতে হবে না। অর্থাৎ এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে রাজধানীবাসীকে যানজট থেকে মুক্তি দেয়া।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে ৫ কিলোমিটার। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজট পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে ভয়াবহ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়বে। প্রকল্পের মহাপরিকল্পনায় এসব বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকায় বড় সড়কের সংখ্যা হাতেগোনা। ট্রাফিক মোড়গুলো শহরের বিষফোঁড়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাতের অবৈধ দখল, ভাসমান বিক্রেতাদের সড়ক দখল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়া অন্যতম। তা ছাড়া দুই শতাধিক কোম্পানির অধীনে শহরের বাস সেবা পরিচালিত হওয়ার ফলে যাত্রী ওঠানো নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতাও যানজটের অন্যতম কারণ।
সব পেশার, সব বয়সি মানুষ যানজটে ভোগান্তির শিকার। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যানজট নিরসনে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। যানজট নিরসন একক কোনো সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে এর সমাধান করতে হবে। নতুন এ প্রকল্পটি হবে তারই প্রয়াস।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন যায়যায়দিনকে বলেন, রেলপথ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খুবই আন্তরিক। আর যেহেতু প্রকল্পটিতে জাপান সরকার অর্থায়ন করবে তাতে সরকারের সরাসরি কোনো বিনিয়োগ করতে হবে না। তবে যেহেতু এ প্রকল্পের সঙ্গে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় যুক্ত হবে তাদের সমন্বয় করাটা হবে তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
উলেস্নখ্য, ২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের 'নগর পরিস্থিতি-২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত' শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। ##